রাউজানে আট মাসে ৮ হত্যাকাণ্ড, নেপথ্যে চাঁদাবাজি, দখল-আধিপত্য

চট্টগ্রামের রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গরিব উল্লাহপাড়া গ্রামে ১৯ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে ভাত খাওয়ার সময় গুলি ও ছুরিকাঘাত করে যুবদল কর্মী মানিক আবদুল্লাহকে (৩৬) হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১২-১৫ জনের মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা। অনেকটা এভাবে গত আট মাসে রাউজানে আটটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। 

নিহত মানিক আবদুল্লাহ বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ওই ইউনিয়নের গরিব উল্লাহপাড়া গ্রামের আব্দুল মোতালেবের ছেলে।

পুলিশ, নিহতের স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চাঁদাবাজি, দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ২৮ আগস্ট থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত আট জন খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জনের বেশি। প্রায় প্রতিদিন ঘটছে দখল, মাটি কাটা, পাহাড় কাটা, চাঁদাবাজি, দলীয় গ্রুপিং এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা। এসব ঘটনায় ব্যবহার হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। একের পর এক খুন, সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। ধরা পড়ছে না জড়িতরা। তবে হত্যায় জড়িতরা এলাকায় ঘুরলেও পুলিশ ধরছে না বলে অভিযোগ স্বজনদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনা ঘটলেও হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ২৮ আগস্ট থেকে। ওই দিন বিকালে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী মার্কেট এলাকায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নের শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুল মান্নানকে (২৭)। তিনি বেতবুনিয়া সুগারমিল ডাকবাংলো এলাকার কবির আহাম্মদের ছেলে। ১ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাগানবাড়ি থেকে মো. ইউসুফ মিয়া (৬৫) নামে এক ব্যক্তির রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত ইউসুফ রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল শুক্কুর মিয়ার বাড়ির মৃত শামসু মিয়ার ছেলে। 

পুলিশ বলছে, শ্রমিক লীগ নেতা মান্নানকে রাজনৈতিক বিরোধে হত্যা করা হলেও ইউসুফকে কেন হত্যা করা হয়েছে, তা এখনও উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে বলে দাবি পুলিশের।

১১ নভেম্বর নিখোঁজের তিন দিনের মাথায় রক্তাক্ত অবস্থায় হাফেজ মাওলানা আবু তাহের (৪৮) নামে এক মাদ্রাসাশিক্ষকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি রাউজানের চিকদাইর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আকবর শাহ (রহ.) বাড়ির প্রয়াত আব্দুল মান্নানের ছেলে। এ হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক বিরোধে হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন ধারণা করলেও পুলিশ বলছে এটির তদন্ত চলছে। এখনও কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গত ২৪ জানুয়ারি উপজেলার নোয়াপাড়া এলাকায় মোটরসাইকেলে করে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন মো. জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যবসায়ী। জাহাঙ্গীর আলম নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নিরামিশপাড়ার মৃত আবু ছৈয়দ মেম্বারের ছেলে। জাহাঙ্গীর নগরের খাতুনগঞ্জের পাইকারি শুঁটকি ব্যবসায়ী ছিলেন।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মুহাম্মদ হাসান (৩৫) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা। নিহত হাসান নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আহমেদ হোসেন মেম্বারের বাড়ির মো. বজল আহমেদ ড্রাইভারের ছেলে। তাকেও রাজনৈতিক বিরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।

গত ১৫ মার্চ ইফতার মাহফিল নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের পিটুনি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন কমর উদ্দিন জিতু (৩৬) নামে এক যুবদল কর্মী। কমর উদ্দিন জিতু হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর সর্ত্তা গ্রামের মুহাম্মদ আলীর ছেলে। তিনিও রাজনৈতিক বিরোধে খুন হন।

গত ২১ মার্চ পূর্বগুজরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বৃহত্তর হোয়ারাপাড়া এলাকার মোবারক খালের পূর্ব পাশে খোলা জমি থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মো. রুবেল (৩৫) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। গরু চোর সন্দেহে তাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। নিহত রুবেল নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার মৃত নুরুল আলমের ছেলে। সর্বশেষ ১৯ এপ্রিল রাতে খুন হন যুবদল কর্মী মানিক আবদুল্লাহ। এ ঘটনায় জড়িত কাউকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

এর মধ্যে ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম হত্যাকাণ্ড বেশ আলোচনায় ছিল। এ ঘটনায় নিহতের বড় ছেলে মাকসুদ আলম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মাকসুদ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাবাকে দিনদুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ এ ঘটনায় পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে রয়েছেন মামুন, রমজান আলী, গিয়াস উদ্দিন, বিপ্লব বড়ুয়া ও নেজাম উদ্দিন। অথচ আমার বাবাকে হত্যায় জড়িত সবার কাছে অস্ত্র ছিল। পুলিশ অস্ত্রগুলো উদ্ধার করতে পারেনি। হত্যায় জড়িতদের সংখ্যাও আরও বেশি ছিল। তাদের অধিকাংশকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। অথচ পুলিশ হত্যায় জড়িতদের সিসিটিভি ফুটেজে দেখেছে।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলম হত্যায় মামুনই মূলহোতা। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করে আমরা তা পেয়েছি। জাহাঙ্গীরকে চাঁদার জন্য খুন করা হয়। সন্ত্রাসীরা চাঁদা চেয়ে না পেয়ে হত্যা করেছে বলে স্বীকারও করেছে।’

নিজ ঘর থেকে তুলে নিয়ে যুবলীগ কর্মী হাসানকে হত্যা করা হলেও পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়নি। নিহতের স্ত্রী ঝিনু আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর অপরাধ তিনি যুবলীগ করতেন। এজন্য ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। যারা হত্যা করেছে, তাদের সবাই চেনে। অথচ পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। বিচার পাবো না, এজন্য মামলা করিনি। আমার স্বামী হত্যার বিচার আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিলাম।’

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টায় পূর্ব গুজরা ইউনিয়নে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হন উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও ঠিকাদার পেয়ার মোহাম্মদ বাবু। এ ঘটনায় ১৮ মার্চ রাউজান থানায় মামলা করেছেন তিনি। মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখসহ পাঁচ-ছয় জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করেছে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে মামলার প্রধান আসামি রায়হানসহ বাকিরা।

এ প্রসঙ্গে পেয়ার মোহাম্মদ বাবু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এখনও চলাফেরা করতে পারছি না। পুলিশ মাত্র তিন জনকে গ্রেফতার করেছে। এজাহারভুক্ত আসামিদের বেশিরভাগ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরছে। প্রতিদিন চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছে। এরপরও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না।’

কোটি টাকা চাঁদা চেয়ে না পেয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর একটি ইটভাটায় হামলা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় উপজেলার পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এস এম শফির ছেলে এস এম শহিদ উল্লাহ বাদী হয়ে রাউজান থানায় মামলা করেন। পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত একজনকেও গ্রেফতার করেনি বলে জানালেন শহিদ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলায় ৫ আগস্টের পর বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত লেগে আছে। এর মধ্যে একটি পক্ষের নেতৃত্বে আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, আরেকপক্ষে আছেন উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার। ১৭ আগস্ট উপজেলার মদুনাঘাট জিয়াবাজার এলাকায় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে ১২ জন আহত হন। ৭ সেপ্টেম্বর পথেরহাট বাজারে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের অনুসারীদের সংঘর্ষে মুহাম্মদ ফরিদ নামে এক যুবদল নেতা গুলিবিদ্ধসহ আট জন আহত হন। ১৪ নভেম্বর নোয়াপাড়া এলাকায় দুই পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে আবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচ জন গুলিবিদ্ধসহ ২০ জন আহত হন। ৬ ডিসেম্বর উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে ১০ জন আহত হন। 

গত ২৩ জানুয়ারি বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। উপজেলা পরিষদ চত্বর ও মুন্সিরঘাটা এলাকায় এ সংঘর্ষে বিএনপির উভয় পক্ষের ১২ জন আহত হন।  

১৯ মার্চ উপজেলার নোয়াজিশপুর ইউনিয়নে ইফতার মাহফিল আয়োজনকে কেন্দ্র করে আবারও বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে গুলিবিদ্ধসহ ১৫ জন আহত হন।

নোয়াপাড়া পথেরহাট এলাকার বাসিন্দা নুরুল আবছার বলেন, ‘বিএনপির দুই পক্ষের বিরোধের কারণে নোয়াপাড়া এলাকা অস্থির হয়ে আছে। প্রায় ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। সাধারণ মানুষ এতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা তেমন দেখা যাচ্ছে না।’

গত ১ ফেব্রুয়ারি রাউজান বিএনপির এক পক্ষের সভাপতি জসিম উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে অভিযোগ করেন, গত ১৭ বছর রাউজানের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেনি। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি আসে। তবে বিএনপির একটি পক্ষ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে পুরোনো কায়দায় এলাকায় বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি ও খুনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এতে রাউজানের মানুষ আবারও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়েছেন। তারা সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, রাউজানের ৪৮টি ইটভাটার মধ্যে প্রতিটি থেকে দুই লাখ করে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামগামী কাঠবোঝায় প্রতি ট্রাক থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা আদায়, রাউজান মুন্সিরঘাটা ও নোয়াপাড়া এলাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও লোকজনের কাছ থেকে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। পশ্চিম গুজরায় ১৫ শতাংশ চাঁদা না দেওয়ায় ব্রিজের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সিআইপি ফোরকানের ওপর হামলা করা হয়েছে। সিআইপি ইয়াসিনের বাড়িতে হামলা করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের জিম্মি করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। বড় অংকের টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির একটি পক্ষ এসব ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। মূলত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে এজন্য দায়ী করছেন তারা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা যে দলের হোক তাদের বিরুদ্ধে যেন পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়, এটাই আমার চাওয়া। বিএনপিতে সন্ত্রাসীদের কোনও স্থান নেই।’

রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভূইঁয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘রাউজানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে পুলিশ। যারা অপরাধ করছে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।’