‘মব’ সৃষ্টি করে প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে জোরপূর্বক পদত্যাগে স্বাক্ষর

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী হাজী তোবারক আলী চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বুধবার (১৬ এপ্রিল) দুপুরে প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য।

বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সীতাকুণ্ড থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তিনি।

দিনদুপুরে স্কুলে ‘মব’ সৃষ্টি করে প্রধান শিক্ষককে টেনেহিঁচড়ে বের করে দেওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রামজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

স্কুল প্রধান শিক্ষকের দাবি, স্কুল পরিচালনায় এডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে বিএনপিপ্রার্থীর পরিবর্তে জামায়াতপ্রার্থীর নাম আসায় তার ওপর এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে ঘটনায় জড়িতদের দাবি, প্রধান শিক্ষক একজন দুর্নীতিবাজ। তিনি বিগত সময়ে স্কুল থেকে অনেক টাকা আত্মসাৎ করেছেন। উত্তেজিত জনতার চাপে তিনি নিজেই পদত্যাগ করে চলে গেছেন।

হাজী তোবারক আলী চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য বাংলা ট্রিবিউনকে শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) বলেন, ‘এ স্কুলে আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্যার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত ফেব্রুয়ারির দিকে সরকারি প্রজ্ঞাপন আসে স্কুলে এডহক কমিটি গঠনের জন্য। বিষয়টি জানাজানি হলে ভাটিয়ারী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নুরুল আনোয়ার এসে স্কুল পরিচালনা কমিটিতে রাখার জন্য দুই জনের নাম দিয়ে যান। এরপর জামায়াতে ইসলামী থেকেও একজনের নাম দেওয়া হয়। আমি সব নাম ইউএনও অফিসে পাঠিয়ে দিই। পরে ৬ এপ্রিল স্কুলের এডহক কমিটি অনুমোদন পায়। এতে জামায়াতের দেওয়া ব্যক্তি মহিউদ্দিন আহমেদকে সভাপতি, হারুনুর রশিদকে শিক্ষক প্রতিনিধি, বিএনপির সালাউদ্দিনকে অভিভাবক প্রতিনিধি এবং পদাধিকার বলে প্রধান শিক্ষক এ কমিটিতে সচিব হিসেবে রাখা হয়।’

তিনি বলেন, ‘কমিটি অনুমোদন হওয়ার পর নুরুল আনোয়ার আমাকে ফোন করে বলেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি নিয়ে আপনি কাজটি ভালো করেননি। পরে ১০ এপ্রিল নবগঠিত এডহক কমিটির সভাপতিসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা এলে আমরা তাদের ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিই। স্কুলে ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে মিছিল করে এক দেড়শ লোক ঢুকে অনুষ্ঠানের মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষককে সেদিন স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। আমার অফিস (প্রধান শিক্ষক) এবং অফিস সহকারীর অফিসে তালা লাগানো হয়। তবে অসুস্থতার কারণে আমি সেদিন স্কুলে যাইনি। পরে এডহক কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বিষয়টি ইউএনও স্যারকে জানান। পরে ওই দিন বিকাল বেলায় তালা খুলে দেওয়া হয়। ১৫ এপ্রিল স্কুল বন্ধ ছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘১৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে তখন আমি আমার অফিসে বসা ছিলাম। মিছিল করে একদল লোক আসতে থাকে। তারা আমার অফিসে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে মার মার বলতে থাকে। একপর্যায়ে লোকজন আমাকে টেনেহিঁচড়ে লাঞ্ছিত করতে থাকে। তখন আমাকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বলেন তারা। আমি সেটি পড়ে দেখি সেখানে লেখা ছিল “দুর্নীতির-অনিয়মের কারণে আমি স্বেচ্ছায় প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে পদত্যাগ করলাম।” তখন আমি প্রতিবাদ করি। আমি বলেছি আমি এমন কী দুর্নীতি করেছি? দায়িত্ব পাওয়ার পর উপজেলার মধ্যে এ স্কুলকে এ গ্রেডে উন্নীত করেছি। আমার দুর্নীতি থাকলে সংশ্লিষ্ট সংস্থা আছে। দুর্নীতি তদন্ত করুক। দুর্নীতি প্রমাণিত হলে আমি নিজেই দায়িত্ব ছেড়ে দেবো। এ কাগজে আমি স্বাক্ষর না করায় কিছুক্ষণ পর দেখি আরও একটি কাগজ আমাকে দেয়। এটাতে স্বাক্ষর করতে বলেন তারা। এটাতে লেখা আছে, “আমি আমার ব্যক্তিগত কারণে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলাম।” তাদের জোড়াজুড়ির কারণে সেখানে স্বাক্ষর করতে আমি বাধ্য হয়েছি। পরে আমাকে স্কুল থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে বের করে দেওয়া হয়। আমাকে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার সময় আমার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ফারুক হোসেন প্রতিবাদ করলে তার ওপর হামলা করা হয়। হামলায় তার মাথা ফেটে যায়। কোনোরকম প্রাণ নিয়ে আমি বাড়িতে এসেছি। আমি এখন নিজে ও পরিবার নিয়ে আতঙ্কে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমার ওপর মব সৃষ্টি করে জোরপূর্বক যারা পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়েছে তাদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’

স্কুল পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপি-সমর্থিত লোকজন বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এসে জোরপূর্বক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়েছে। বিষয়টি অমানবিক। একজন শিক্ষকের সঙ্গে এমন কর্মকাণ্ড কখনও মেনে নেওয়া যায় না। পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর গ্রহণকারীদের অভিযোগ, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দুর্নীতি অনিয়ম করেছে। এজন্য তার পদত্যাগপত্র নিয়ে বের করে দিয়েছে। আমি তাদের বলেছি যদি দুর্নীতি করে থাকে সব কিছুর তদন্ত হবে। এতে প্রধান শিক্ষক যদি দোষী প্রমাণিত হয় তখন তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু তারা শোনেননি। পরবর্তীতে আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে বিষয়টি অবগত করেছি।’

এ প্রসঙ্গে ভাটিয়ারী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নুরুল আনোয়ার বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে অনেক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এজন্য বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা তার পদত্যাগ দাবি করে মিছিল-সমাবেশ করেন। উত্তেজিত জনতার চাপে প্রধান শিক্ষক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘হাজী তোবারক আলী চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে জোর করে পদত্যাগ করানোর বিষয়টি জেনেছি। কোনও শিক্ষককে পদত্যাগ না করাতে সরকারের বেশ কয়েকটি পরিপত্র রয়েছে। এ বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

জানা গেছে, ১৯৯১ সালের ১ মার্চ সহকারী শিক্ষক হিসেবে হাজী তোবারক আলী চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ে যোগদান করেন কান্তি লাল আচার্য। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রধান শিক্ষকের পদ খালিসাপেক্ষে এবং জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক করা হয়। স্কুলটিতে বর্তমানে ২ হাজার শিক্ষার্থী আছে।