বর্তমানে বাংলাদেশি পতকাবাহী সমুদ্রগামী বিদেশি জাহাজ আছে ১০২টি। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) বহরে আছে মাত্র পাঁচটি। বাকি ৯৭টি পরিচালনা করছে দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে আগামী পাঁচ বছরে (২০৩০ সাল) বিএসসির বহরে আরও ২২টি নতুন জাহাজ যুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সংস্থাটি। এই উদ্যোগ সফল হলে বিএসসির বহরে ২৭টি জাহাজ হবে।
গত রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বাংলা ট্রিবিউনকে এসব তথ্য জানিয়েছেন নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘বিশ্বে মালামাল পরিবহনে সমুদ্রগামী বিদেশি জাহাজের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশি জাহাজ আছে ১০২টি। তবে এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আরও কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাহাজ বাড়ানোর চিন্তা করছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিএসসিও জাহাজ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার মাত্র এক বছর পর ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে বিএসসি। ১৯৭২ সালে ‘বাংলার দূত’ ও ১৯৭৩ সালে ‘বাংলার সম্পদ’ নামে জাহাজ যুক্ত হয় বিএসসিতে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএসসি এ পর্যন্ত ৪৪টি জাহাজ সংগ্রহ করে। বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক বিবেচিত হওয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৯টি জাহাজ বিক্রি করা হয়। বর্তমানে বিএসসির বহরে জাহাজ আছে পাঁচটি। সেগুলো হলো- এমভি বাংলার জয়যাত্রা, এমভি বাংলার অর্জন, এমটি বাংলার অগ্রগতি, এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা এবং এমটি বাংলার অগ্রদূত।
এর মধ্যে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য সর্বোচ্চ ২৪৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা বার্ষিক মুনাফা করেছে বিএসসি। এটি সংস্থাটির ৫৩ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফার মাইলফলক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগের বছর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ২৪৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছিল।
বিএসসি সূত্র জানিয়েছে, সংস্থাটি এখন ২২টি নতুন জাহাজ অধিগ্রহণের মাধ্যমে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন বাজারের একটি বৃহত্তর অংশ দখল করার টার্গেট নিয়েছে। জাহাজ কেনার তালিকায় রয়েছে ছয়টি বাল্ক ক্যারিয়ার, আটটি মাদার ট্যাঙ্কার, ছয়টি কনটেইনার জাহাজ এবং তিনটি রাসায়নিক/তেল ট্যাঙ্কার। এর মধ্যে বাল্ক ক্যারিয়ারের ধারণক্ষমতা হবে ৫৫ হাজার থেকে ৬৬ হাজার টন, আটটি মাদার ট্যাঙ্কারের ধারণক্ষমতা হবে এক লাখ ১৪ হাজার টন, ছয়টি কনটেইনার জাহাজের ধারণক্ষমতা হবে বিশ ফুট সমতুল্য কনটেইনারের দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার বহন করবে। তিনটি রাসায়নিক/তেল ট্যাঙ্কারের প্রতিটির ধারণক্ষমতা হবে ৪০ হাজার টন। অপরদিকে পাঁচটি বাল্ক ক্যারিয়ারের মধ্যে দুটি বিএসসি নিজস্ব তহবিল থেকে কিনতে চাইছে। প্রতিটি বাল্ক ক্যারিয়ার ৮০০ থেকে ৮৫০ কোটি টাকায় কেনা হবে।
বিএসসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে আমদানিতব্য ক্রুড অয়েল বিএসসির নিজস্ব জাহাজের মাধ্যমে পরিবহনের জন্য ও দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে কয়লাসহ বিভিন্ন পণ্য যেমন: খাদ্যশস্য, সিমেন্ট ক্লিংকার, ক্লে এবং বাল্ক কার্গো ইত্যাদি পরিবহনের জন্য নতুন প্রতিটি এক লাখ ১৪ হাজার টন ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি নতুন ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাঙ্কার ও নতুন প্রতিটি ৮১ হাজার ৫০০ টন ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার কেনার ‘জি টু জি’ ভিত্তিতে দুটি ক্রুড ওয়েল মাদার ট্যাঙ্কার এবং দুটি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ নির্মাণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সঙ্গে কমার্শিয়াল/জাহাজ নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীন সরকারের সম্মতি মিলেছে। ঋণ আবেদন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের বরাবর পাঠানো হয়েছে। ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাহাজ নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করা হবে।
বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিপিং উপদেষ্টা ইতিমধ্যে বিদেশে দুটি জাহাজ পরিদর্শন করেছেন। আগামী মাসে আরেকটি সফরের কথা রয়েছে। আমরা আশা করছি, শিগগিরই জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবো। প্রথম পর্যায়ে সিএমসি থেকে দুটি অপরিশোধিত তেল মাদার ট্যাঙ্কার এবং দুটি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার সংগ্রহের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে জাহাজ নির্মাণ শুরু হবে। এ ছাড়া কোরিয়া থেকে ছয়টি কনটেইনার জাহাজ কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। আশা করছি, ২০৩০ সালের মধ্যে বিএসসির বহরে ২২টি জাহাজ যুক্ত হবে। এই লক্ষ্যে দ্রুত কাজ চলমান আছে।’
নৌ বাণিজ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, স্বাধীনতার পর দুটি জাহাজ দিয়ে পণ্য পরিবহন শুরু করেছিল বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। বাংলাদেশি পতাকাবাহী ১০২ জাহাজের মধ্যে পাঁচটি জাহাজ আছে বিএসসির। ২৮টি কেএসআরএমের বহরে। ২৫টি জাহাজ আছে মেঘনা গ্রুপের বহরে। আকিজ গ্রুপের বহরে আছে ১০টি। এইচ আর লাইনের বহরে আছে আটটি। বসুন্ধরা গ্রুপের বহরে আছে চারটি। ভ্যানগার্ড গ্রুপের বহরে আছে সাতটি। ক্রাউন সিমেন্টের বহরে আছে তিনটি। দরিয়া শিপিংয়ের বহরে আছে দুটি। হানিফ গ্রুপের বহরে আছে তিনটি। পিএনএন গ্রুপের বহরে আছে দুটি, সানসাইন নেভিগেশন ইন্ডাস্ট্রিজের বহরে একটি, পিএইচ নেভিগেশনের বহরে আছে একটি, টিকে গ্রুপের বহরে একটি, ডরিন গ্রুপের বহরে একটি এবং এমজেএল গ্রুপের বহরে আছে আরও একটি সমুদ্রগামী জাহাজ।
গত বছর এর বাইরে আরও ছয়টি জাহাজ বহর থেকে ছিটকে পড়েছে। এর মধ্যে অগ্নিকাণ্ডে বিএসসির দুটি জাহাজ বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভকে স্ক্র্যাপ করার জন্য বিক্রি করা হয়েছে। দুটি জাহাজই ট্যাঙ্কার। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাকি চার জাহাজের মধ্যে কেএসআরএম গ্রুপের বাল্ক ক্যারিয়ার খাদিজা জাহান, ওরিয়ন গ্রুপের ট্যাঙ্কার জাহাজ ওরিয়ন এক্সপ্রেস এবং বসুন্ধরা গ্রুপের দুটি গ্যাস ক্যারিয়ার জাহাজ বসুন্ধরা এলপিজি। এসব জাহাজ দুর্ঘটনা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় সমুদ্রের বহর থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।