সাতটি জাহাজ নিয়ে কোনোমতে কার্যক্রম চালাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের জাহাজ বারবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অদক্ষতার ছাপ সুস্পষ্ট হচ্ছে। একের পর এক বিপদ পিছু ছাড়ছে না। তবু এর সমাধান পাচ্ছেন না প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। সর্বশেষ সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ডলফিন জেটিতে নোঙর করা অবস্থায় বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায় বিএসসির মালিকানাধীন জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতিতে। জমে থাকা গ্যাস থেকেই আগুন ধরেছে বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে ২০২২ সালের ২ মার্চ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে বিএসসির জাহাজ এমভি বাংলার সমৃদ্ধিতে মিসাইল হামলা হয়েছিল। এতে জাহাজটির তৃতীয় প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান নিহত হন। ১৪ মার্চ তার লাশ দেশে আনা হয়। জাহাজটি আক্রান্ত হওয়ার পর ২৮ নাবিককে উদ্ধার করে বাংকারে সরিয়ে নেওয়া হয়। ৯ মার্চ তাদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটি ২৯ জন নাবিক ও প্রকৌশলীকে নিয়ে ২০২২ সালের গত ২২ ফেব্রুয়ারি অলভিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সেখানেই অবস্থান করেছিল। ওই দিন ভোরেই রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। হামলার সপ্তম দিনে বাংলাদেশি জাহাজে মিসাইল হামলা হয়েছিল, এতে হাদিসুরের প্রাণ যায়।
চট্টগ্রাম শিপিং করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের অধীনে এ পর্যন্ত ৪৪টি বিভিন্ন ধরনের জাহাজ কেনা হয়েছে। প্রথম জাহাজটি কেনা হয় ১৯৫৪ সালে ‘এমভি সিলেট’। দুর্ঘটনা, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় অধিকাংশ জাহাজ এখন প্রতিষ্ঠানটির বহরে নেই। এমনকি ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির বহরে ছিল ১৪টি জাহাজ। পরবর্তীতে নতুন জাহাজ যুক্ত হওয়ায় ১৯৮২ সালে বহরে ছিল ২৭টি। ২০০৮ সালে ১৩টিতে নেমে আসে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তিনটি করে ছয়টি কেনা হয়। ছয়টির মধ্যে তিনটি ‘অয়েল কেমিক্যাল ট্যাংকার’ ও বাকি তিনটি ‘বাল্ক ক্যারিয়ার’। সর্বশেষ সাতটি জাহাজ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল প্রতিষ্ঠানটি। সাতটির মধ্যে রয়েছে এমটি বাংলার জ্যোতি, এমটি বাংলার সৌরভ, এমভি বাংলার জয়যাত্রা, এমভি বাংলার অর্জন, এমটি বাংলার অগ্রগতি, এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা ও এমটি বাংলার অগ্রদূত।
বিএসসির জাহাজে যত দুর্ঘটনা
সর্বশেষ সোমবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম বন্দরের ডলফিন জেটিতে নোঙর করা অবস্থায় বাংলার জ্যোতি জাহাজে বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। জাহাজটি তেল পরিবহনে আর দেখা যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১৯৮৭ সালে এমটি বাংলার জাহাজটি বিএসসির বহরে যুক্ত হয়েছিল। এটি ডেনমার্কের তৈরি।
ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এমভি বাংলার সমৃদ্ধি। ২০১৮ সালে এটি বিএসসির বহরে যুক্ত হয়েছিল। হামলার পর থেকে সেটি ইউক্রেনের বন্দরেই পড়েছিল। তবে এর জন্য ২০২৩ সালে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল বিএসসি। ক্ষতিপূরণ বাবদ বিমা কোম্পানির কাছ থেকে দুই কোটি ২৪ লাখ মার্কিন ডলার পাওয়া গেছে। তখন প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১০৬ টাকা ধরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ২৩৭ কোটি টাকা। ফলে সেটির স্থলে বিএসসির বহরে কোনও জাহাজ যুক্ত হয়নি।
তার আগে বিস্ফোরণে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল এমটি বাংলার সৌরভ। সেই দুর্ঘটনায় একজন ডেক ক্যাডেটের মৃত্যু হয়। ২০০৭ সালের জুন মাসে এ দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এরপর দেড় বছর জাহাজটির কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সেটি মেরামতের দায়িত্ব দেওয়া হয় কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স প্রতিষ্ঠানকে। দেড় বছর পর সচল হয়। এখনও সচল আছে। জাহাজটি ১৯৮৬ সালে তৈরি করেছিল ডেনমার্ক। বিএসসির বহরে জাহাজটি যুক্ত হয় ১৯৮৭ সালের ১৫ মে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল বহরে থাকা অন্যান্য জাহাজও।
কারণ অজানা
কেন বারবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে সরকারি জাহাজ জানতে চাইলে তার কোনও সঠিক জবাব দেননি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের সচিব আবু সাফায়াৎ মুহম্মদ শাহে দুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বিএসসির বহরে জাহাজ সংখ্যা সাতটি। এর মধ্যে সোমবার একটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। তবে এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং দক্ষ জনশক্তির অভাব
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. শাখাওয়াত হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএসসির জাহাজ একসময় আরও বেশি থাকলেও বর্তমানে আছে সাতটি। তার মধ্যে একটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে জাহাজের বহর আরও বেশি থাকার কথা ছিল। তা কিন্তু নেই। সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং দক্ষ জনশক্তির অভাবে প্রতিষ্ঠানটি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না।’
পরিচালনায় অদক্ষতার কারণে বারবার জাহাজগুলো দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে উল্লেখ করে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘একসময় একটি মাত্র জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল কেএসআরএম, মেঘনা এবং আকিজ গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠানের বহরে এখন ২০-২৫টি করে জাহাজ আছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী বড় জাহাজ আছে ১০০টি। তবে এর সংখ্যা হওয়ার কথা ছিল ৫০০ থেকে ৬০০টি। সারা বিশ্ব যে হারে নৌ-বাণিজ্যের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ উদাসীন। জাহাজ বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ প্রসারিত হবে।’
আরও পড়ুন: স্টোরে জমে থাকা গ্যাস থেকেই বাংলার জ্যোতি জাহাজে আগুন