রেকর্ড উৎপাদনেও লবণের দাম নিয়ে অস্বস্তিতে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা

আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন চট্টগ্রামের অর্ধশতাধিক চামড়া ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, এবার তীব্র তাপদাহের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হলেও দাম কমেনি। ফলে তাদের কোরবানির পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাতের জন্য লবণ কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। আর এ কারণে এবারও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা খুব একটা লাভের প্রত্যাশা করতে পারছেন না। ব্যবসায়ীদের দাবি, এবছরও চট্টগ্রামের বেশিরভাগ কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি হবে ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে।

নগরীর আতুরার ডিপো থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত পশুর চামড়ার বেশ কিছু আড়ত রয়েছে। এই আড়তের ব্যবসায়ীরা ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে কাঁচাচামড়া প্রক্রিয়াজাত করার জন্য গুদাম প্রস্তুত করছেন। পাশাপাশি মজুদ করা হচ্ছে লবণসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।

এবছর লবণযুক্ত গরুর চামড়ার ঢাকায় দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৬০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা সরকার।

চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘এবার ঈদুল আজহায় চট্টগ্রামে ৮ লাখ ৮৫ হাজারের মতো পশু কোরবানি দেওয়া হবে। গত বছরের তুলনায় এবার কোরবানি দাতাও বেড়েছেন ৬ হাজারেরও বেশি।’  

চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিটি বড় গরুর চামড়া ৬০ ফুট এবং ছোট গরুর চামড়া ২৫ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এসব কাঁচা চামড়া কেনার পর সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে প্রতি চামড়ার পেছনে অন্তত সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামে কোরবানিতে অন্তত ৪ লাখ পর্যন্ত পশুর চামড়া সরাসরি কোরবানি দাতা এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে আমাদের আড়তদারদের কাছে আসে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে আছে একটি মাত্র ট্যানারি। এ ট্যানারির ব্যবসায়ীরা মোট ১ লাখের মতো পশুর চামড়া কিনে থাকেন। এরমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ৫০ হাজার এবং অন্যান্য জেলা থেকে আরও ৫০ হাজার চামড়া সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। আর বাকি চামড়া ঢাকার ট্যানারিগুলোর কাছে বিক্রি করতে হয়। আগের বছরগুলোতে ঢাকার ট্যানারিগুলোর কাছে বিক্রি করা চামড়ার প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো এখনও বকেয়া। এসব টাকা আদায়েই আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সমিতিতে ১১২ জন সদস্য রয়েছে। এরমধ্যে বর্তমানে চামড়া সংগ্রহ করে এমন আড়তদারের সংখ্যা ৫০ জনের বেশি হবে না। ২০১৫ সাল থেকে পশুর চামড়া কম দামে বিক্রি হচ্ছে। বেশি দামে আড়তদারগন চামড়া কিনে কম দামে বিক্রি করতে হয়েছিল। এতে লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে অর্ধেকের বেশি আড়তদার এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে।’

এক সময় চট্টগ্রামে ২০ থেকে ২২টি ট্যানারি ছিল বলে জানান জ্যেষ্ঠ এই ব্যবসায়ী। এসব ট্যানারি একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। গত কয়েক বছর আগে ‘রিফ লেদার’ নামে একটি ট্যানারি গড়ে উঠেছে কালুরঘাট শিল্প এলাকায়। সেখানে ১ লাখের মতো চামড়া সংগ্রহ করা হয়ে থাকে বলেও উল্লেখ করেন এই ব্যবসায়ীও।

এখন চামড়া প্রক্রিয়াকরণ খরচও বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন মুসলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘কাঁচাচামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যয় বেড়েছে। এবার লবণের ভালো ফলন হলেও বর্তমানে ৭৪ কেজি একটি লবণের বস্তা কিনতে হচ্ছে ৯৮০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকায়। প্রতিটি চামড়ায় ৯ থেকে ১০ কেজি করে লবণ দিতে হয়। সরকার লবণজাত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। একটি কাঁচা চামড়া কেনার পর সেটিকে বিক্রির উপযোগী করতে আরও ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ করতে হয়।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘চামড়া অতি মূল্যবান সম্পদ। চামড়া যাতে নষ্ট না হয় এজন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেসব এতিমখানাগুলো কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তারা যেন নিজেরাই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে তা ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চলছে। প্রয়োজনে তাদেরকে বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করা যায় কিনা তা দেখা হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেছেন, ‘চামড়া পাচার রোধে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোন এলাকায় যাতে সিন্ডিকেট তৈরি করে কোরবানির চামড়া বেচাকেনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি চামড়া বেচা-কেনা এবং পরিবহনে কেউ যাতে চাঁদাবাজি করতে না পারে তা নিশ্চিত করা হবে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘কোরবানি পশুর চামড়া যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হবে। পাশাপাশি নগরীর পার্শ্ববর্তী জেলা-উপজেলার কোরবানির চামড়া যাতে নগরীতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ঈদের দিনসহ পরবর্তী দুই দিন নগরীর প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসানো হবে। নগরীতে চামড়া প্রবেশ ঠেকাতে ম্যাজিস্ট্রেট ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করবে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা।’