বরিশাল সিটি করপোরেশন

মেয়রের ফ্রি পার্ক ও অবৈধ দোকান থেকে টাকা তুলছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

উদ্বোধনের নয় বছর পর বরিশাল গ্রিন সিটি পার্কে ‌‘সেবামূল্যের’ নামে প্রবেশ ও রাইড ব্যবহারে টিকিটের ব্যবস্থা করে টাকা তুলছে সিটি করপোরেশন (বিসিসি)। একইসঙ্গে পার্ক সংলগ্ন বেলস পার্ক এলাকায় ফুটপাত ও সড়ক দখল করে বসা অবৈধ ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকেও টাকা তোলা হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ নগরবাসী।

নগরের বাসিন্দা ও অভিভাবকরা বলছেন, গত নয় বছর ধরে বরিশাল গ্রিন সিটি পার্কে ‌টিকিট ছাড়াই ঢুকতে পারতেন নগরের বাসিন্দারা। সেইসঙ্গে পার্কের রাইডগুলো বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারতো শিশুরা। হঠাৎ করে গত রোজার ঈদের দিন থেকে সেখানে টিকিটের ব্যবস্থা করে টাকা তুলছে সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি বেলস পার্ক এলাকায় ফুটপাত ও সড়ক দখল করে বসা অবৈধ ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকেও টাকা তোলা হচ্ছে। বিষয়টি নগরের ফুটপাত ও সড়ক দখল করা বসা অবৈধ দোকানিদের উৎসাহিত করছে। 

তবে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দাবি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তাপ্রহরীর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জন্য নামমাত্র টাকা তোলা হচ্ছে।

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের লক্ষ্যে ২০১৬ সালের ২৯ জানুয়ারি তৎকালীন মেয়র আহসান হাবিব কামাল বরিশাল সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে গ্রিন সিটি পার্কের উদ্বোধন করেন। পার্কটি নির্মাণে এবং রাইডসহ ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা। এক একর জমির ওপর এটি নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে শিশুদের খেলাধুলার জন্য মাঠ রয়েছে। এ ছাড়া আছে ১৪টি রাইড, ১০টি বসার বেঞ্চ, দুটি খাবার ঘর ও একটি বিশ্রামাগার। রক্ষণাবেক্ষণ করছে সিটি করপোরেশন। রাইড ও অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহারে টাকা নেওয়া হবে না। থাকবে না প্রবেশমূল্য। উদ্বোধনের পর এই সিদ্ধান্ত দেন তৎকালীন মেয়র।

আহসান হাবিব কামাল ব‌রিশাল মহানগর বিএন‌পির সভাপ‌তি ও কেন্দ্রীয় বিএন‌পির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ সাল থেকে তিনি বিলুপ্ত বরিশাল পৌরসভার কমিশনার, ১৯৯৫ সালে চেয়ারম্যান ও প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বরিশাল সিটি করপোরেশন হলে ২০০২ সালের ২৫ জুলাই থেকে ২০০৩ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি প্রথম ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন।

গত নয় বছর ধরে বরিশাল গ্রিন সিটি পার্কে ‌টিকিট ছাড়াই ঢুকতে পারতেন নগরের বাসিন্দারা

কিন্তু উদ্বোধনের নয় বছর পর ৩১ মার্চ ঈদুল ফিতরের দিন থেকে সেখানে প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ১০ টাকা নির্ধারণ করে গার্ড বসিয়ে দেন সিটি করপোরেশনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এরপর অভিভাবকরা শিশুদের নিয়ে পার্কে প্রবেশ করতে গিয়ে হোঁচট খান। যেখানে বছরের পর বছর ফ্রিতে চলছিল পার্কটি সেখানে হঠাৎ প্রবেশ ফি দেখে হতভম্ব হয়েছেন তারা। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর নিয়ে তারাও জেনেছেন সিটি করপোরেশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিষয়টি জানিয়ে ওই দিনই কয়েকজন অভিভাবক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের খবর দেন। পরে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক বিভাগীয় কমিশনার মো. রায়হান কাওছার সেখানে উপস্থিত হয়ে প্রবেশমূল্য সিটি করপোরেশন থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে বলে অভিভাবকদের জানিয়ে দেন।

ওই সময় বিভাগীয় কমিশনার অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপত্তাপ্রহরীসহ ১৫ জন কাজ করবেন। তাদের বেতন এবং যাবতীয় খরচ ওই টিকিটের টাকা থেকে মেটানো হবে। এতে করে পার্কটি পূর্বের চেয়ে অনেক ভালো থাকবে।’

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গ্রিন পার্ক থেকে প্রতিদিন গড়ে টাকা উঠছে ২০ হাজার টাকা। সেটি থেকে পার্কটির যাবতীয় খরচ দেওয়া হচ্ছে।

ঈদের পরদিন সন্তানদের নিয়ে গ্রিন সিটি পার্কে আসা সোহরাব হোসেন ও আসমা আক্তারসহ একাধিক অভিভাবক জানান, বিনামূল্যে যে সময় পার্কে আসতেন তখন পরিবেশ তেমন ভালো ছিল না। তবে এখন রাইড থেকে শুরু করে মাঠের অবস্থা অনেক ভালো। প্রবেশমূল্য নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। তবে এক্ষেত্রে গরিব ও দরিদ্র পরিবারের শিশুরা বিনামূল্যে পার্কে ঢোকা থেকে বঞ্চিত হবেন। আগের মতো ফ্রি থাকলে ভালো হতো।

আরেক অভিভাবক মৌরিন আক্তার বলেন, আগের মেয়র এটি ফ্রি রেখে গেছেন। সেখানে সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা পেয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ট্যাক্স বসিয়ে দিলেন। অথচ কোনও রাইড কিংবা নতুন কিছু সংযোজন করেননি। এটি ঠিক হয়নি। এখানে সব শিশুরা আসতো। এখন সেটি বন্ধ হয়ে গেলো।

অপরদিকে, গ্রিন সিটি পার্ক সংলগ্ন বেলস পার্কের ফুটপাত ও সড়ক দখল করে রয়েছে দেড় শতাধিক ভাসমান দোকানঘর। ঈদের দিন থেকে ওসব দোকান থেকে টাকা তুলতে শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। ব্যবসার ধরন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৫০ টাকা থেকে সর্বনিম্ন ২০ টাকা পর্যন্ত টাকা তোলা হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়।

এ নিয়ে ফুচকা, শরবত, চা, চটপটি ও আইসক্রিম বিক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, টাকা নির্ধারণের আগে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এই স্থান পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে ব্যবসার ধরন অনুযায়ী প্রতিদিন টাকা নিচ্ছে। এতে করে খরচ বেড়ে গেছে আমাদের মতো দরিদ্র দোকানিদের।

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল জেলার সদস্যসচিব রফিকুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে, ‘গ্রিন সিটি পার্কটি এতো বছর সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। হঠাৎ করে সিটি করপোরেশন সেবার নামে প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করেছে। তবে তা আরও কমিয়ে আনতে হবে।’

বেলস পার্ক এলাকায় ফুটপাত ও সড়ক দখল করে বসা অবৈধ ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকেও টাকা তোলা হচ্ছে

রফিকুল আলম আরও বলেন, ‘বেলস পার্কের সামনে থাকা ভাসমান দোকান থেকে টাকা উত্তোলন একেবারেই অবৈধ। কারণ দোকানগুলোই অবৈধ। সেখান থেকে টাকা তুলে সিটি করপোরেশন অবৈধকে বৈধতা দিচ্ছে। যা পরবর্তীতে নগরের ফুটপাত ও সড়ক দখলে ভাসমান ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করবে। এখান থেকে তাদের সরে আসতে হবে। ওই দোকান উচ্ছেদ করে নগরে চলাচল স্বাভাবিক করতে হবে। কারণ এসব দোকানের কারণে ফুটপাত ও সড়ক দিয়ে চলাচল করা যায় না।’

এ ব্যাপারে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গ্রিন সিটি পার্কের রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পাহারার দায়িত্বে রয়েছেন ১৫ জন। তাদের বেতনসহ অন্যান্য খচর উত্তোলনে সেবামূল্য হিসেবে ১০ টাকা টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। একইভাবে গ্রিন পার্ক সংলগ্ন বেলস পার্কের সামনে থাকা ভাসমান দোকানের কারণে সেখানে ময়লার স্তূপ জমে থাকে। তা পরিষ্কার করা বাবদ ব্যবসার ধরন অনুযায়ী কিছু টাকা উত্তোলন তোলা হচ্ছে।’

অবৈধ দোকান থেকে টাকা তুলে সেগুলোকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নগরের অন্য কোনও জায়গা থেকে এ ধরনের টাকা উত্তোলন করা হয় না। শুধুমাত্র দুটি পার্ক সেখানে থাকায় নগরবাসী এবং ভাসমান ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে ওই টাকা তোলা হচ্ছে।’

এসব খরচ তো সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ থেকে দেওয়ার কথা এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘৫ আগস্টের পর মন্ত্রণালয় থেকে কোনও ধরনের বরাদ্দ আসেনি। বরাদ্দ আনার চেষ্টা চলছে। তাছাড়া পানির বিল, ট্যাক্সসহ নগরবাসীর কাছে বকেয়া রয়েছে অনেক টাকা। সেই টাকাও উত্তোলন করা যাচ্ছে না। এতে করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।’