উপাচার্যের বাসভবনের ফটক ভেঙে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, স্থগিত হলো সিন্ডিকেট সভা

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ শুক্রবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বিকালে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে উপাচার্য শুচিতা শরমিনের বাসভবনে ঢুকে বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় উপাচার্য বাসভবনে ছিলেন। বিকালে উপাচার্যের বাসভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করলে শিক্ষার্থীরা ওই সভা বাতিল করার দাবি তোলেন। শিক্ষার্থীদের হট্টগোলে পর সভাটি স্থগিত করে ভার্চুয়াল মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

শিক্ষার্থীদের ওই অংশ আজ দুপুরে উপাচার্য শুচিতা শরমিনের বিরুদ্ধে দুই শিক্ষক প্রতিনিধিকে সিন্ডিকেট থেকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের দোসরদের পুনর্বাসনের অভিযোগ এনে এবং পাতানো সিন্ডিকেট প্রতিহত করার ডাক দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান নিয়ে তারা নানা স্লোগান দেন। পরে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েন।

এ সময় শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, শুক্রবার বিকালে উপাচার্য যে সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করেছেন, তাতে কোনও এজেন্ডা নেই। নিজের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তিনি গোপনীয়তার সঙ্গে এই সভা আহ্বান করেছেন। আমরা এই সিন্ডিকেট সভা মানি না।’

এ সময় উপাচার্যের বাসভবনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলেন সহকারী প্রক্টর মারুফা আক্তার। মারুফা আক্তার শিক্ষার্থীদের জানান, সিন্ডিকেট সভা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অত্যন্ত গোপনীয় সভা। এবারের সভায় নতুন করে তো কোনও এজেন্ডা আসবে না। কোনও ফ্যাসিস্টকে সিন্ডিকেট সদস্য বা অন্য কোনও দায়িত্ব দেওয়া হবে না।

এ সময় সহকারী প্রক্টর শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে প্রক্টর কার্যালয়ে আলোচনায় বসার জন্য শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তারা উপাচার্যের সঙ্গে তার বাসভবনেই কথা বলতে চান।

শিক্ষার্থীরা সহকারী প্রক্টরকে বলেন, ‘আমরা কয়েক মাস আগে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ২২ দফা দাবি দিয়েছিলাম। কিন্তু আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আপনারা পাতানো সিন্ডিকেট দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন করতে চাচ্ছেন। আমরা পাতানো সিন্ডিকেট মানি না। আমরা অযোগ্য প্রক্টরের পদত্যাগ চাই।’

এ সময় শিক্ষার্থীরা উপাচার্যেরও পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান দেন। পরে উপাচার্যের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে ১০ দফা দাবি তুলে ধরেন ওই শিক্ষার্থীরা। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলাম, দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিম বিল্লাহ, লোকপ্রশাসন বিভাগের মোকাব্বেল শেখ, মাইদুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আশরাফুল মোল্লা, ইতিহাস বিভাগের মোশাররফ হোসেন, আবদুল করিম, মিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।

রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের দোসররা ক্যাম্পাসে অবাধে বিচরণ করছে। যারা জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তাদের যথাযথ বিচার নিশ্চিত করতে হবে। উপাচার্যের দায়িত্ব ছিল ক্যাম্পাসকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করা। কিন্তু তিনি তা করেননি। এমনকি শিক্ষার্থীদের কোনো চাওয়াই পূরণ করতে পারেননি। বরং উপাচার্য আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ও তাঁর সহযোগী রেজিস্ট্রারকে বহাল রেখেছেন।’

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পাতানো সিন্ডিকেট ও আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন ঠেকাতে আমরা শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছি। আমাদের ১০ দফা দাবি মেনে না নিলে ও সঠিক ব্যাখ্যা না দিলে আমরা এক দফা দাবিতে যেতে বাধ্য হব। আগামীকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা থাকায় রোববার থেকে আমরা কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলব।’

শিক্ষার্থীদের ১০ দফা

শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবিগুলো হলো রেজিস্ট্রারের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ; অভ্যন্তরীণ শিক্ষকদের প্রতিনিধি করে সিন্ডিকেট সভা আহ্বান; মেয়াদ শেষ না হওয়ায় বাতিল করা দুই শিক্ষককে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা; ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা; সিন্ডিকেটে ছাত্র প্রতিনিধি রাখার বিধান; সিন্ডিকেটের আলোচ্য বিষয় সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করা; অবকাঠামো উন্নয়নে নিয়োগ পাওয়ার পর উপাচার্যের পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রমাণ সাপেক্ষে উপস্থাপন করা; বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টার কাছে দ্রুত সময়ের মধ্যে চিঠি পাঠানো; স্বৈরাচারের দোসরদের সঙ্গে সখ্যের কারণ স্পষ্ট করে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরে ক্ষমাপ্রার্থনা এবং গত প্রশাসনে বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে যারা ছিলেন, তাদেরকে নতুন পদ বণ্টন না করা ও শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন।

এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে হঠাৎ উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করে বিক্ষোভ শুরু করেন একদল শিক্ষার্থী। এই দাবিতে ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের বাসভবন ও তাঁর কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন তাঁরা।

শিক্ষার্থীরা জানান, গত বছরের ২৭ নভেম্বর উপাচার্য শুচিতা শরমিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে পদত্যাগের দাবি তুলে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন তারা। পরে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পদত্যাগ না করায় ২৮ নভেম্বর দুপুরে উপাচার্যের কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের ওই অংশ। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অপর একটি অংশ উপাচার্যের পক্ষ নেওয়ায় এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে বাগবিতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কি হয় দুই দল শিক্ষার্থীর মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদে শিক্ষার্থীদের ২২ দফা দাবি বাস্তবায়নে উপাচার্য সম্মত হলে ওই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

গতকাল আবারও আন্দোলনের সূচনা হয় ৬ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফরহাদ উদ্দীন এবং সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক মোস্তাকিম মিয়াকে সিন্ডিকেট সদস্য পদ বাতিল করার প্রতিবাদে। দুই বছরের জন্য তারা নির্বাচিত হয়েছিলেন গত বছরের ৩০ এপ্রিল।

এসব নিয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য শুচিতা শরমিন বলেন, দুই জন শিক্ষককে সিন্ডিকেট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। ওই দুই শিক্ষক ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তাঁরা বাদ দেওয়া দাবি তুলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের ২২ দফা নিয়ে আলোচনা করে সেসব দফার বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু তারপরও একের পর এক ইস্যু তৈরি করে এভাবে আন্দোলন করাটা কাম্য নয়। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। প্রশাসনিক নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও বিঘ্ন ঘটছে। শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে আগেও আমরা আলোচনা করেছি, প্রয়োজনে আবার বসব। যতবার লাগে ততবার বসব। তারপরেও আমার অনুরোধ থাকবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ যাতে বিঘ্ন না হয়, সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা যেন সচেতন থাকেন।’