কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে ৬ জনের বাড়ি বরগুনায়। এদের মধ্যে বরগুনা সদরের ২, বেতাগী উপজেলার ২, তালতলী উপজেলার ১ এবং বামনা উপজেলার ১ জন। তারা সবাই গুলিতে নিহত হয়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসন সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জনা যায়, তারা সবাই ছিলেন নিম্ন আয়ের মানুষ। ঢাকায় কেউ দিনমজুর, অটোচালক, ঠেলাগাড়ির শ্রমিক, মোটর মেকানিক, ভ্যানচালক, প্রাইভেটকারচালক, কেউবা আবার টাইলস মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন।
নিহতদের পরিবারে একদিকে মাতম চলছে, অন্যদিকে বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। অনেকের পরিবারের আয়ের মাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন সূত্র ও নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কেউই সংঘর্ষে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে অথবা বাসা থেকে কাজে যাওয়ার পথে আর না হয় কাজ করার সময় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মারা গেছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ সুপারের (এসপি) কার্যালয়ের তথ্যমতে, নিহতরা হলেন বরগুনা সদর উপজেলার ৮ নম্বর সদর ইউনিয়নের কালিরতবক গ্রামের দুলাল হাওলাদারের ছেলে মো. মিজানুর রহমান (৩০), একই উপজেলার ২ নম্বর গৌরীচন্ন ইউনিয়নের দক্ষিণ মনসাতলী গ্রামের টিটু মৃধার ছেলে সায়েম মৃধা (২১), তালতলী উপজেলার মৌপাড়া গ্রামের আলতাফ হোসেনের ছেলে আমির হোসেন (২৬), বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের নীলখোলা এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে মো. টিটু (৩৫), একই ইউনিয়নের উত্তর করুনা গ্রামের মো. তৈয়ব আলীর ছেলে মো. লিটন (২৮) ও বামনা উপজেলার লক্ষ্মীপুরা গ্রামের দুলাল মিয়ার ছেলে মো. শাকিল (২০)।
জানা যায়, নিহত মিজানুর রহমান ঢাকার মানিকনগর এলাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন। গত ২০ জুলাই সন্ধ্যায় কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরে মুগদা মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। সায়েম মৃধা আবদুল্লাপুর এলাকায় মোটর মেকানিকের কাজ করতেন। গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় আবদুল্লাপুর বাসস্ট্যান্ডে তার মাথায় গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। স্বজনরা তাকে আবদুল্লাপুর গণকবরে দাফন করেন। আমির হোসেন শহরে অটোরিকশা চালাতেন। তিনি গত ১৯ জুলাই দুপুর আড়াইটার দিকে রামপুরা টিভি সেন্টার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। দুই সন্তানের জনক টিটু ছিলেন প্রাইভেটকারচালক। গত ১৯ জুলাই দুপুর ১টার দিকে ধানমণ্ডি গ্রিন রোডে মাথায় গুলি লেগে গুরুতর আহত হন। পরে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। লিটন টাইলস মিস্ত্রির কাজ করতেন। তিনি গত ১৮ জুলাই বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মধ্য বাড্ডা এলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এ ছাড়া শাকিল চালাতেন ভ্যানগাড়ি। গত ২০ জুলাই জুরাইন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ যায় তার।
নিহত টিটুর স্ত্রী আয়েশা বেগম জানান, তার স্বামী সর্বশেষ গত ১১ জুলাই বাড়ি থেকে কর্মস্থল ঢাকায় যান। বাড়িতে থাকা অবস্থাতেই ঘরে বাজার ছিল না। এরই মধ্যে গত শুক্রবার বিকালে ফোন করে তাদের এক নিকট আত্মীয় জানান, তোমার স্বামীর গায়ে গুলি লেগেছে। সে ধানমণ্ডির গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। সে তো কোনও আন্দোলন করেনি। তারপরেও বিনা অপরাধে তাকে জীবন দিতে হলো। ছেলে সাইমুন বাবার জন্য পাগল ছিল। ওকে কিছুতেই থামাতে পারছি না। শুধু বাবাকেই খুঁজছে। মেয়ে তামান্না ঠিকমতো খাবার খাচ্ছে না। আমি অবুঝ সন্তানদের কী বুঝ দেবো? আমার সংসার কীভাবে চলবে?’
নিহত মিজানুর রহমানের বাবা দুলাল হাওলাদার বলেন, ‘আমার ছেলে কোরবানির ঈদের একদিন পরেই ঢাকা চলে গেছে। সে ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করতো। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমার ভায়রা ভাই ফোন দিয়ে বলে মিজানুর কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সেখানে থাকা লোকজনের সহযোগিতায় তাকে মুগদা মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিসাধীন অবস্থায় মারা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার সংসার চালাতেই কষ্ট হয়। এর মধ্যে ছোট ছোট দুটি ছেলে-মেয়ে রেখে মারা গেছে মিজানুর। কীভাবে চলবে সংসার, কে দেখবে ওদের? অনেক অসহায় হয়ে পড়েছি আমরা।’
বরগুনা সদর উপজেলার ৮ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুস আলো আকন বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনায় আমার ইউনিয়নের মিজানুর রহমান নামের একজন নিহত হয়েছেন। মিজানুরের পরিবার অনেক অসহায়। ও ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করতো। ঘটনা শুনে আমরা মিজানুরের পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে মিজানুরের পরিবারকে কিছু সহযোগিতা করেছি। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব সহযোগিতা করা হবে।’
এ বিষয়ে বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুখ আহম্মেদ বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেতাগী উপজেলার ২ জন নিহত হয়েছেন। আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছি এবং খাদ্যসামগ্রী দিয়েছি। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা অনুযায়ী নিহতের পরিবারের জন্য কাজ করে যাবো।’
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় জেলার যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রত্যেক পরিবারের খোঁজখবর আমরা নিয়েছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী ও নগদ অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে যে সকল অনুদান আসবে তা নিহতের পরিবারকে দেওয়া হবে।’