ঝালকাঠিতে বাস দুর্ঘটনায় নিহত ১৭

চলন্ত অবস্থায় যাত্রীর সঙ্গে তর্কাতর্কি চালকের, পুকুরে পড়ার সময় গেলেন পালিয়ে 

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। এর মধ্যে দ্রুতগতিতে বাস চালাচ্ছিলেন চালক। পুরো গাড়িতে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীরা। ছাদে আছেন কয়েকজন। এরপরও যাত্রী তোলায় এক নারী সুপারভাইজারের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান।। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন চালক। তখন ওই নারীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান চালকও। এরই মধ্যে সামনে এসে পড়ে একটি অটোরিকশা। সেটিকে সাইড দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি পুকুরে ফেলে লাফ দিয়ে পালিয়ে যান চালক। সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় ১৩ জনের লাশ। আহত হন আরও ৪০ যাত্রী। আহতদের উদ্ধার করে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে আরও চার জনকে মৃত ঘোষণা করেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক।

এভাবেই দুর্ঘটনার শিকার হন পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে ছেড়ে আসা বরিশালগামী ‘বাসার স্মৃতি’ পরিবহনের যাত্রীরা। ওই বাসের আহত চার যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। শনিবার (২২ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন ছত্রকান্দা এলাকায় বাসটি পুকুরে পড়ে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বাসে ছিলেন ৬০ জনের বেশি যাত্রী। দুর্ঘটনার জন্য গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা এবং চালকের তর্কাতর্কিকে দায়ী করেছেন যাত্রীরা।

নিহতদের মধ্যে ১১ জন ভান্ডারিয়ার, চার জন রাজাপুরের এবং দুই জন কাঁঠালিয়া উপজেলার বাসিন্দা। স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই ১৪ জনের লাশ হস্তান্তর করেছে জেলা প্রশাসন। বাকি তিন জনের লাশ এখনও শনাক্ত হয়নি। তাদের লাশ সদর হাসপাতালের নিচতলার মেঝেতে রাখা হয়েছে। আহত ৩৫ জনের মধ্যে ৩১ জনকে ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল ও চার জনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

শনিবার সকালে অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে আসছিল বাসটি

সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাসের যাত্রী আবুল বাশার, রাসেল মোল্লা ও ফাতেমা আক্তার ভান্ডারিয়া থেকে বরিশালে আসছিলেন। পথিমধ্যে দুর্ঘটনার শিকার হন। তারা জানিয়েছেন, সকালে ৬০ জনের বেশি যাত্রী নিয়ে ভান্ডারিয়া থেকে বরিশালের দিকে যাচ্ছিল বাসার স্মৃতি পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটি। ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের আগে এক নারীকে তোলা হয়। ওই নারী সুপারভাইজারের কাছে জানতে চান, আসন না থাকা সত্ত্বেও কেন এত যাত্রীর মাঝে তাকে তোলা হলো। তখন সুপারভাইজার রেগে গেলে বাগবিতণ্ডায় জড়ান। এ সময় চালকও বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। ঠিক তখন একটি অটোরিকশা সামনে এসে পড়ে। সেটিকে সাইড দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি পুকুরে ফেলে চালক, সুপারভাইজার ও হেলপার পালিয়ে যান। এরপর কী হয়েছে, কীভাবে তারা হাসপাতালে এসেছেন, তা সম্পর্কে জানাতে পারেননি এই তিন যাত্রী। 

বাসের আহত যাত্রী আব্দুর রহিম বলেন, ‌‘চালক এক হাতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। মাঝেমধ্যে পেছনে ফিরে ওই নারীর সঙ্গে তর্কবিতর্ক করছিলেন। হঠাৎ বাসটির সামনে অটোরিকশা এসে পড়ে। সেটিকে সাইড দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে ফেলে দেন। বাসটি পুকুরে পড়ার সময় লাফ দিয়ে চালক ডান দিক থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান। বাসটিতে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী ছিল। পুকুরে পড়ার পর ছাদে এবং ভেতরে থাকা কয়েকজন যাত্রী সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হন। কিন্তু ভেতরে গাদাগাদি করে থাকা নারী-শিশুরা বের হতে পারেননি। স্থানীয়রা আমাদের উদ্ধার করে। দুর্ঘটনার জন্য চালক-সুপারভাইজার দায়ী। তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল ‍নিঝুম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাসের আহত যাত্রী, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, যাত্রীদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বাসটি। এরপরও দুর্ঘটনার কারণ জানতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানা যাবে।’

ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ এবং স্থানীয়দের উদ্ধার অভিযান

ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর বাসচালক ও সুপারভাইজার পালিয়ে গেলেও তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছি আমরা। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেফতার করা হবে।’

ফারাহ গুল ‍নিঝুম বলেন, ‘দুর্ঘটনাকবলিত স্থানে আর কারও লাশ আছে কিনা, তা দেখার জন্য দমকল বাহিনীকে পুকুরটি সেচ দিতে বলা হয়েছে। সেচ দেওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে, সেখানে কারও লাশ আছে কী নেই। তবে এখন পর্যন্ত ১৭ জনের লাশ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৪টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি তিন জনের লাশ শনাক্তের পর হস্তান্তর করা হবে।’