ওই মামলার প্রধান আসামি বাকেরগঞ্জের দুধল গ্রামের রশিদ খানের ছেলে বাদল। আর বাদলের সঙ্গে চুক্তি করেন বরিশালের এক পুলিশ কর্মকর্তার চালক কনস্টেবল সিরাজুল ইসলাম। ওই ঘটনার পর সিরাজ সিলেটে বদলি হয়ে চলে যায়। সিরাজের সঙ্গে বাকেরগঞ্জের দাড়িয়াল ইউনিয়নের কাজলাকাঠী গ্রামের সাবেক মেম্বর ও বর্তমানে বাবুগঞ্জ পোস্ট অফিসে কর্মরত আলম কারিকরও রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মামলার প্রধান আসামি বাদল খান জানান, গত বছর কোনও ধরনের ঘুষ ছাড়াই বরিশাল জেলায় কনস্টেবল পদে ৪৪ জনের চাকরি হয়। কিন্তু কনস্টেবল সিরাজুল ইসলাম ৭ জনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিলেও তাদের চাকরি দিতে ব্যর্থ হন। এরপর ওই ৭ জনকে চাকরি দিতে, যাদের চাকরি হয়েছে সেখান থেকে ৭ জনকে চিহ্নিত করে তাদের হাত-পা কেটে বিছিন্ন করতে জনপ্রতি দুই লাখ টাকা করে চুক্তিতে সন্ত্রাসী ভাড়া করেন।
ওই বছর ২১ আগস্ট কনস্টেবল পদে চাকরি হওয়া বরিশাল সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের সোমরাজি গ্রামে বিজয় কৃষ্ণের হাত কাটতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয় ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী শানু ও মিজান। এ ঘটনায় ২২ আগস্ট বিজয়ের পিতা বীরেন্দ্র চন্দ্র কৃষ্ণ মামলা দায়ের করলেও এক বছরেও চার্জশিট দিতে পারেনি পুলিশ। এমনকি অভিযুক্ত সিরাজের বিরুদ্ধেও নেওয়া হয়নি কোনও আইনি পদক্ষেপ। সম্প্রতি ওই দুই জন কারাগার থেকে জামিনে বের হয়েছে।
পলাতক বাদলের ৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের ফোনালাপ এখানে তুলে ধরা হলো:
‘বরিশালের ডিআইজি স্যারের ড্রাইভার সিরাজ পুলিশ (ভোলার বাসিন্দা)। সিরাজ পুলিশ ঠিক করে আলম কারিকর নামের এক লোককে। আলম আমার পরিচিত। তার বাড়ি বাকেরগঞ্জের কাজলকাঠী গ্রামের সিদ্দিক বাজারে। আলম কারিকর আমার কাছে কয়েদিন আসে। এরপর বলে আমার একটি কাজ করে দিতে হবে। এ সময় আমি বলি, আমি অসুস্থ, কী কাজ করে দেবো। আপনি না পারলে লোক ঠিক করে দেন। কী কাজ করতে হবে? সাহেবের হাটের একটি হিন্দু পোলার হাত কাটতে হবে। আর একটি পোলা রয়েছে হিজলতলায় তারও হাত কাটতে হবে। কিসের জন্য হাত কাটতে হবে? এ সময় আলম জানায়, তা তোমার জানার দরকার নেই।’
‘পরে আলম সিরাজ পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়িতে আসে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওই সময় সিরাজ পুলিশ এক লাখ টাকা নিয়ে আসে। সিরাজ পুলিশ জানায়, আমি বরিশালের এডিশনাল ডিআইজি স্যারের ড্রাইভার। আপনার কোনও সমস্যা নেই। আপনার যেখানে যা লাগবে, তা আমি দেখবো। তখন আমি জানাই, আমি এ ধরনের কাজ করি না। তাছাড়া আমি অসুস্থ। আমার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। তখন সিরাজ পুলিশ বলে, আপনার কাজ করার দরকার নেই। আপনি লোক ঠিক করে দেন। তখন আমি দুই জন লোক ঠিক করে দিই বাকেরগঞ্জের শানু ও মিজানকে। একেক জনের হাত কাটলে দুই লাখ টাকা করে দেবে বলে জানায় সিরাজ পুলিশ। শুধু দুই জনের নয়, ৭ জনের হাত কাটলে জনপ্রতি দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। আর যাদের হাত কাটতে হবে তাদের একটি তালিকা সিরাজ পুলিশ তার নিজ হাতে লিখে দেয় আমার কাছে। কিন্তু প্রথম কাজ করতে যাইয়া ধরা খায় শানু ও মিজান। আটক ব্যক্তিরা সিরাজ ও আলমের নাম জানে না। তারা জানে আমার নাম। তারা পুলিশের কাছে আমার নাম বলেছে। বিষয়টি নিয়ে সিরাজ পুলিশের সঙ্গে কথা বললে সে জানায়, তোমার কোনও সমস্যা নেই। আমি তোমাকে জামিন করিয়ে দেবো।’
‘সিরাজ পুলিশ অনেক লোকের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে নিয়েছে। তাদের চাকরি দিতে পারে নাই। ওই দুই জনের হাত কাটতে পারলে, ওই দুই জনের স্থলে সে যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে তাদের চাকরি দেবে। এ চুক্তি হয় চাকরিতে যোগদানের এক সপ্তাহ আগে। কাজ না হওয়ায় সিরাজ পুলিশ আমার বাড়ি গিয়ে আমার কাছে দেয়া এক লাখ টাকা ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ে আসে। এখন তাকে মোবাইল করলে ধরে না।’ বাদল বলেন, ‘এখানে মিথ্যার কিছুই নেই।’
মোবাইলে বাদল বলেন, ‘যাদের যাদের হাত-পা কাটতে হবে তাদের একটি তালিকা দিয়েছে সিরাজ পুলিশ। ৪টি স্লিপে যাদের নাম রয়েছে তারা হচ্ছে—মফিজুল ইসলাম, পিতা: বশির উদ্দিন মিন্টু, মাতা: পারভীন বেগম, নগরীর ১০ নম্বর ওয়ার্ড। নাইম বিশ্বাস, পিতা: ফারুক বিশ্বাস, মাতা: পারভীন বেগম, দুধল মৌ, বাকেরগঞ্জ। কাউছার হোসেন, পিতা: ছালাম হাওলাদার, মাতা: বিউটি বেগম, কোতোয়ালি। জুবায়ের ইসলাম, পিতা: নুরুজ্জামান, মাতা: মনজুয়ারা বেগম, সাহেবগঞ্জ, বাকেরগঞ্জ। শাহাবুদ্দিন, পিতা: আবুল হোসেন বেপারী, মাতা: ফজিলাতুন্নেছা, শ্রীপুর মেহেন্দীগঞ্জ। বিজয় কৃষ্ণ, পিতা: বিরেন কৃষ্ণ, মাতা: অঞ্জনা রানী, সোমরাজী এবং তারেকুর রহমান, পিতা: খবির উদ্দিন, মাতা: জাহানারা বেগম, হিজলতলা, ৩ নম্বর ওয়ার্ড।’
বাদল এ প্রতিবেদকের কাছে সব ঘটনা প্রকাশ করে আত্মসমর্পণ করবেন বলে জানান। একইসঙ্গে সিরাজ পুলিশকে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানান তিনি।
এ ব্যাপারে মামলার বাদী বীরেন্দ্র চন্দ্র কৃষ্ণ অভিযুক্ত সবার বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোখলেচুর রহমান বলেন, ‘অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে আইনের আওতায় আনা না হলে দেশে এ ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পাবে, বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং মানুষ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘মামলার পুরো রহস্য উদঘাটনে আরও কিছু তদন্ত বাকি রয়েছে। তদন্তে যারাই অভিযুক্ত হবে, সে যদি পুলিশ সদস্যও হয়, তাকেও আইনের আওতায় আসতে হবে।’
অভিযোগ অস্বীকার করে কনস্টেবল সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি বাদলকে চেনেন না। তার বিরুদ্ধে বাদল অপপ্রচার চালাচ্ছেন।