আজ ২৯ এপ্রিল

সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি আজও তাড়া করে উপকূলের বাসিন্দাদের

আজ মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল)। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ইতিহাসে এক ভয়াল দিন। ১৯৯১ সালের এই দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রামসহ দেশের উপকূলীয় জেলা-উপজেলাগুলোর অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারান। তিন দশক পেরিয়ে গেলেও সেই বিভীষিকার স্মৃতি আজও তাড়া করে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের।

চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, মিরসরাইসহ চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে আজও নির্মিত হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ। এসব এলাকার বেশির ভাগ বেড়িবাঁধ পুরনো, দুর্বল এবং অনেক স্থানে ভেঙে গেছে। উপকূলীয় এলাকাগুলোতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় সামান্য ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনাতেও স্থানীয়রা আতঙ্কে দিন কাটান।

স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম ও ঘূর্ণিঝড়ের আগে বেড়িবাঁধগুলো সাময়িক মেরামতের কাজ করা হলেও তা খুবই অপ্রতুল। কোথাও কোথাও বাঁধে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। যা অল্প ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসেই ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ে শুধু বাঁশখালীতেই প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ হাজার মানুষ। ওই উপজেলার বাসিন্দারা এখনও ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন। ওই ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের মধুখালী গ্রামের বাসিন্দা শওকত আরা বেগম (৫৬) হারিয়েছেন তার তিন ছেলেমেয়েসহ দশ স্বজনকে। সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় তছনছ করে দিয়েছিল গৃহবধূ শওকত আরার পুরো সংসার। তিন দশকের বেশি সময় ধরে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে দিন কাটে তার। আজও খুঁজে পাননি ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে যাওয়া তিন সন্তানের লাশও। শওকত আরা বেগম স্থানীয় সাংবাদিক মো. বেলাল উদ্দিনের মা।

১৯৯১ সালের সেই স্মৃতি মনে করে শওকত আরা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় শব্দটি শুনলেই আমার বুকে কম্পন শুরু হয়, এই বুঝি আবারও সব কেড়ে নিচ্ছে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ে আমার তিন ছেলেমেয়েকে হারিয়েছি। এ শোক আমি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে গিয়ে আমিও পানিতে ডুবতে বসেছিলাম। তখন স্বজনদের কেউ একজন আমাকে বাঁচিয়েছে।’

শওকত আরা বেগমের ছেলে মো. বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে আমার আট বছর বয়সী বড় ভাই জাহেদুল ইসলাম, ছয় বছর বয়সী ভাই শাহেদুল ইসলাম, আড়াই বছর বয়সী বোন লিলুফার আকতার, দাদি রাবেয়া খাতুন, মেজো চাচি তৈয়বা আক্তার এবং তার দুই সন্তানসহ ১০ জনকে হারিয়েছি। তাদের মধ্যে আমার তিন ভাইবোনের লাশ আজও পাওয়া যায়নি।’

শওকত আরা বেগমের মতো সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়ের সেই দুর্বিষহ স্মৃতি ভুলতে পারেননি উপজেলার গন্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার বাসিন্দা শফকত হোসাইন চাটগামী (৪৬)। তিনি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল তখন আমার বয়স ১২ বছর। ওইদিন জলোচ্ছ্বাসে আমাদের ঘর ভেসে গিয়েছিল। পানির তীব্র স্রোত আর প্রচণ্ড বাতাসে ভেসে যায় পরিবারের সদস্যরা। বাবা মাওলানা রওশন আলী আমাকে একটি বড় গাছের ওপর তুলে দেন। আমি গাছটির ডাল ধরে বসেছিলাম। বাবা আমাকে গাছে তুলে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজে উঠতে পারেননি। মা-বাবা, ভাইবোনকে চোখের সামনে পানির তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেদিন ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই।’

‘সারারাত ওই গাছের ডালে বসেছিলাম। পরদিন ঘূর্ণিঝড় থামার পর নেমে আশপাশে তাকিয়ে দেখি কারও সাড়াশব্দ নেই। পানির স্রোত কমার পর আশপাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। ঘরবাড়ির কোনও অস্তিত্ব নেই। চারদিকে লাশ আর লাশ।’

ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী বিভীষিকার বর্ণনা দিয়ে শফকত হোসাইন চাটগামী বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন বাবাকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে একটি মসজিদের ছাদের ওপর আহত অবস্থায় এবং মা মাহমুদা খানমকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে একটি খেজুর গাছে কাঁটাবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। মা এখনও বেঁচে আছেন। বাবা ২০০৬ সালে মারা গেছেন।’

বাঁশখালী উপজেলার বাসিন্দা বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধের বেশ কিছু অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। ১৯৯১ সালের মতো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলে এ বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষতি হবে। অথচ তিন দশক পরও স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। যে কারণে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কথা শুনলে বাঁশখালী উপজেলার মানুষ এখনও আতঙ্কে থাকেন।’

বাঁশখালী উপজেলায় দায়িত্বরত পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পূর্ব) মো. গোলাম কাদির বলেন, ‘বাঁশখালীতে বেড়িবাঁধ আছে সাড়ে ৩৬ কিলোমিটার। যেসব স্থানে বেশি ঝুঁকি ছিল সেসব স্থানে সংস্কার করা হয়েছে। এবারের বর্ষায় বাঁধ ভাঙার কোনও সম্ভাবনা নেই। পর্যায়ক্রমে বেড়িবাঁধ আরও শক্তিশালী করা হবে।’

এ প্রসঙ্গে পরিবেশবিদ ড. ইদ্রিস আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়ছে। উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় এখনও টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। আমাদের ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধে সক্ষমতা বেড়েছে ঠিকই, তবে যতটুকু বাড়ার কথা তা হয়নি। মানুষের অসচেতনতার কারণে দিন দিন সাগর পাড়ের বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পরিবেশে। তার ওপর জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব তো আছেই। উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের সুরক্ষায় আরও বেশি করে ভাবনা-চিন্তা করতে হবে।’

প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালের ২২ এপ্রিল মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। ২৪ এপ্রিল নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসর হওয়ার সময় এটি আরও শক্তিশালী হয়। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এটির তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং এর গতিবেগ পৌঁছায় ঘণ্টায় ১৬০ মাইলে। ২৯ এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় ১৫৫ মাইল বেগে আঘাত হানে। আঘাতের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং ৩০ এপ্রিল দুর্বল হয়ে যায়।