ঘূর্ণিঝড়ে ১০ স্বজনকে হারানোর শোক এখনও তাড়া করে শওকত আরাকে

ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনলেই এখনও আঁতকে ওঠেন চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালীর বাসিন্দারা। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল এ উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা। ওই ঘূর্ণিঝড়ে শুধু বাঁশখালীতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩০ হাজার মানুষ। আহত হয়েছিলেন সমপরিমাণ মানুষ।

ওই ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের মধুখালী গ্রামের বাসিন্দা শওকত আরা বেগম (৫৫) হারিয়েছেন তার তিন ছেলেমেয়েসহ দশ স্বজনকে। সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় তছনছ করে দিয়েছিল গৃহবধূ শওকত আরার পুরো সংসার। ৩৩ বছর ধরে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে দিন কাটে তার। আজও খুঁজে পাননি আদরের তিন সন্তানের লাশও। শওকত আরা বেগম স্থানীয় সাংবাদিক মো. বেলাল উদ্দিনের মা।

বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় শওকত আরা বেগমের। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় শব্দটি শুনলেই আমার বুকে কম্পন শুরু হয়, এই বুঝি আবারও সব কেড়ে নিচ্ছে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে আমার তিন ছেলেমেয়েকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছি। এ শোক আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। এখনও সেই রাতের স্মৃতি আমার চোখে ভাসে। ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে গিয়ে আমিও পানিতে ডুবতে বসেছিলাম। তখন স্বজনদের কেউ একজন আমাকে বাঁচিয়ে নেয়। আমার স্বামী জাফর আহমেদ ছেলেমেয়েদের শোকে দীর্ঘদিন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল।

‘ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল লাশ আর লাশ। বিলে-খালে সব জায়গায় লাশ। বাঁশখালীর উপকূল হয়ে উঠেছিল এক মৃত্যুপুরী। যেন লাশের নগরী!’

মা শওকত আরা বেগমের উদ্ধৃতি দিয়ে ছেলে বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে আমার আট বছর বয়সী বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম, ছয় বছর বয়সী ভাই সাহিদুল ইসলাম, আড়াই বছর বয়সী বোন নিলুফার আকতার, দাদি রাবেয়া খাতুন, মেজো চাচি তৈয়বা আক্তার এবং তার দুই সন্তানসহ ১০ জনকে হারিয়েছি। সেদিন ঘূর্ণিঝড়ের সময় রাতে আমার পরিবারের সবাই ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। আমাদের টিনশেডের বাড়িটি ছিল একটি খালের পাশেই। রাতে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে হয় জলোচ্ছ্বাসও। হঠাৎ পরিবারের সদস্যরা লক্ষ করেন, পানি ঘরে প্রবেশ করছে। অল্প সময়ের মধ্যে এ পানি বাড়তে থাকে। সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ড বাতাস। একপর্যায়ে পানি ঘরের চাল ছুঁই ছুঁই অবস্থা। এ সময় আমার বাবা তিন ভাইবোনকে নিয়ে একটি বড় গাছে আশ্রয় নেন। কিছুক্ষণ গাছটি আঁকড়ে থাকার পর তিন ভাইবোন বাবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়। বাতাসের গতি এত বেশি ছিল যে বাবা তাদের আর ধরে রাখতে পারেননি। তারা যখন পানিতে ছিটকে পড়ে তখন আমার মা পানিতে ঝাঁপ দেন। আমার মাও পানিতে ডুবতে বসেন। এমন সময় আমার এক চাচি মাকে টেনে তোলেন।’

বেলাল আরও বলেন, ‘আমার তিন ভাইবোনের লাশ আজ অবধি পাওয়া যায়নি। ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন পানি কমে গেলে ঘরের মেঝেতে পড়েছিল আমার দাদিসহ অন্য স্বজনদের লাশ।’

শওকত আরা বেগমের মতো সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়ের সেই দুর্বিষহ স্মৃতি ভুলতে পারেননি বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার বাসিন্দা শফকত হোসাইন চাটগামী (৪৫)। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে আমি নিজের ভাইবোনসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হারিয়েছি। তাদের অনেকের লাশ গত ৩৩ বছরেও খুঁজে পাইনি। দুর্বিষহ এ স্মৃতির কথা আমি এখনও ভুলতে পারিনি। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনলেই আমরা আঁতকে উঠি। ঘূর্ণিঝড় এলে আমাদের আতঙ্কে দিন কাটে।’

শফকত হোসাইন বলেন, ‘১৯৯১ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল তখন আমার বয়স ১২ বছর। ওইদিন জলোচ্ছ্বাসে আমাদের ঘর ভেসে গিয়েছিল। পানির তীব্র স্রোত আর প্রচণ্ড বাতাসে ভেসে যায় পরিবারের সদস্যরা। বাবা মাওলানা রওশন আলী আমাকে একটি বড় গাছের ওপর তুলে দেন। আমি গাছটির ডাল ধরে বসেছিলাম। বাবা আমাকে গাছে তুলে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজে উঠতে পারেননি। মা-বাবা, ভাইবোনকে চোখের সামনে পানির তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেদিন ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই।

‘সারা রাত ওই গাছের ডালে বসেছিলাম। পরদিন ঘূর্ণিঝড় থামার পর নেমে আশপাশে তাকিয়ে দেখি কারও সাড়াশব্দ নেই। পানির স্রোত কমার পর আশপাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। ঘরবাড়ির কোনও অস্তিত্ব নেই। চারদিকে লাশ আর লাশ।’

ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী বিভীষিকার বর্ণনা দিয়ে শফকত বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন বাবাকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে একটি মসজিদের ছাদের ওপর আহত অবস্থায় এবং মা মাহমুদা খানমকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে একটি খেজুর গাছে কাঁটাবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। মা এখনও বেঁচে আছেন। বাবা ২০০৬ সালে মারা গেছেন।’

প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালের ২২ এপ্রিল মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। ২৪ এপ্রিল নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসর হওয়ার সময় এটি আরও শক্তিশালী হয়। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এটির তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং এর গতিবেগ পৌঁছায় ঘণ্টায় ১৬০ মাইলে। ২৯ এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় ১৫৫ মাইল বেগে আঘাত হানে। আঘাতের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং ৩০ এপ্রিল দুর্বল হয়ে যায়।

সরকারি হিসাবে, ওই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ১৯টি জেলার ১০২টি উপজেলা। তবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, খেপুপাড়া, ভোলা ও টেকনাফ। এক লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন মানুষ মারা যায় এবং প্রায় একই পরিমাণ আহত হয়। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৬ মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করেছিল।