হিলারিপাড়ার একটি চায়ের দোকানে বসে কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করছিলাম আমরা। এ সময়ে পাড়ার কারও গাছ থেকে শজনেপাতা পেড়ে বাড়ি ফিরছেন আদুরী রানী দাস (৪৫)। আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে যান আদুরী। তখন তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন পাড়ার বাসিন্দা শেফালি দাস (৫৭)। সেইসঙ্গে বলেন, ‘আদুরীর সঙ্গে কথা বলেন। সেদিনকার সব কথা তার মনে আছে।’
এবার আদুরী বলতে শুরু করলেন, ‘হিলারি ক্লিনটন ম্যাডাম, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সঙ্গীরা যখন এসেছিলেন তার কিছুদিন পর আমার ছোট ছেলের জন্ম হয়েছিল। ছেলেটার নাম রেখেছি ক্লিনটন। আমি ও ছেলের বাবা এখনও তাকে ক্লিনটন বলেই ডাকি। তবে এত বড় মাপের একজন মানুষের (হিলারি) স্বামীর নাম ক্লিনটন হওয়ায় পরে ছেলের নাম পরিবর্তন করে রিপন দাস রেখেছি। যদিও পরিবারের সদস্যরা তাকে ক্লিনটন নামেই ডাকে।’
সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আদুরী দাস। স্বামীর নাম অজিত দাস। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে তাদের। স্বামী কালীগঞ্জের ধোপাদীতে জুতা সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। বড় ছেলে লিটন দাস ভ্যান চালান আর ছোট ছেলে (ক্লিনটন) সেলুনে কাজ করেন। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ছোট মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
আদুরী জানান, সেদিন এই পাড়ায় উৎসব লেগেছিল। হিলারি ক্লিনটন আসার কয়েকদিন আগে থেকে পাড়ায় একটি কেন্দ্র খোলা হয়। যেখানে এখন মন্দির হয়েছে। মন্দিরের উল্টো দিকে রাস্তার পাশে একটা বড় ঘর বানানো হয়। শিশুদের সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে পিটি প্যারেড ও অ্যাসেম্বলি শেখানো হতো। একটা ঢেঁকিঘরও বানানো হয়েছিল। হিলারি আসার দিন রং-বেরঙের মেলা বসেছিল। নানা ধরনের মিষ্টি-মিঠাই, খেলনা এবং পাড়ার শিশুদের সুন্দর সুন্দর পোশাক পরানো হয়েছিল।
২০১৬ সালে প্রথম হিলারিপাড়ায় গিয়েছিলাম আমরা। তখন এলাকার রাস্তাটি কাঁচা ছিল। অনেকের বাড়িঘরও ছিল কাঁচা। এবার গত ৯ সেপ্টেম্বর যাওয়ার পথে পাড়ার রাস্তাটি পাকা দেখা গেছে। কিছু ঘরবাড়ি পাকা হয়েছে। পরিশ্রমী মানুষগুলোর জীবনযাত্রায় কিছুটা গতি এসেছে।
পাড়ার বাসিন্দা শেফালি দাস ২০১৬ সালে একটি সেমিপাকা বাড়ির মালিক ছিলেন। এদিনও তার সঙ্গে দেখা হয়। পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘দাদা খুব ব্যস্ত আছি। একটা নেমন্তন্ন আছে। চান (স্নান) করে এসেছি, বের হবো।’
সেদিন তার ভাঙা ঘরে গিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন ও তার মেয়ে চেলসিয়া ক্লিনটন। তাদের সঙ্গে ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি জানান, ছেলে ও ছেলের বাবা জুতা সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। প্রতি সপ্তাহে কিস্তির ১৫৯০ টাকা দিতে হয়। শেফালি বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের হিলারিপাড়া সমিতির কেন্দ্রপ্রধান।
শেফালির জীবনে একটা নিদারুণ গল্প আছে। একসময় তারা পরের বাসায় থাকতেন। খড়ি বানানোর জন্য প্রতিবেশীদের কাছে একটু গোবর চাইতে গেলেও বিরক্ত হতেন। এখন শেফালি স্বাবলম্বী, বাড়িতে গরু-ছাগল লালনপালন করছেন। কিনেছেন জমি, নিজের জন্য বানিয়েছেন সেমিপাকা ঘর।
শেফালির ভাষ্য, ‘উনি (হিলারি) খুব ভালো মানুষ। আমার ঘরে এসেছিলেন, বসেছেন। আমাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। গরিব বলে কত মানুষের ঘৃণা সয়েছি। সেদিন তারা আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছেন।’
শেফালির বাড়ির অপর পাশেই ছোট বোন তৃপ্তি দাসের ঘর। তার সঙ্গে কথা বলার সময় মাঠের কাজ শেষে বাড়ি ফেরেন স্বামী সরজিৎ দাস। প্রতিবেদকের সঙ্গে স্ত্রীকে কথা বলতে দেখে রেগে যান সরজিৎ। বলতে থাকেন, ‘এই এক গ্রামীণ ব্যাংকের কচকচানির জন্য আপনাদের প্রতি মাসেই এখানে আসতে হয়? গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূস সাহেবরা লাভবান হন, আমাদের তো ঘাম ঝরিয়ে আয়-রোজগার করা লাগে।’
স্বামীর রাগ কিছুটা সামাল দিয়ে তৃপ্তি দাস বলেন, ‘তিনি (সরজিৎ) ডায়াবেটিসের রোগী। মেজাজ একটু গরম। এজন্য মাঝেমধ্যে রেগে যান। যার-তার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। কিছু মনে করবেন না।’
পাড়ার ৭০ বছর বয়সী মীনা রানী দাস ২০ বছর আগে স্বামী কেতু দাসকে হারান। এখন ছেলে কালীদাস (৩৫) সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। সেদিন মীনা রানীর বাড়িতেও গিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন, চেলসিয়া ক্লিনটন এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজও সেই স্মৃতি মনে আছে তার। তারই বাড়ির পাশে এখন যেটি বাঁশবাগান, সেখানে আয়োজন করা হয়েছিল মেলার। মেলায় এলাকার লোকজন ছাড়াও বাইরের মানুষজন এসেছিলেন।
মীনা রানী বলেন, ‘হিলারি, তার মেয়ে চেলসিয়া, ড. ইউনূস আমার বাড়ির উঠানে এসেছিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন হিলারি। সেই ছবি আমার কাছে এখনও আছে।’
এ কথা বলে তিনটি বাঁধাই করা ছবি বের করে দেখান মীনা রানী। ছবিতে দেখা যায়, হিলারি, চেলসিয়া এবং ড. ইউনূসের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন মীনা রানী। কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হন। এরপর বলেন, ‘সেসময় আমার বাড়ির জায়গা ছিল দুই শতাংশ। পরে আরও দুই শতাংশ কিনেছি। এখন চার শতাংশ জমি আছে।’
জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের বিষয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হিলারিপাড়ার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়তো হয়নি। কিন্তু কাজকর্ম করে মোটামুটি সবাই ভালো আছেন।’
একই বিষয়ে জানতে চাইলে বারবাজার ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) জিএম শাহিনুর রেজা বলেন, ‘হিলারিপাড়ার মানুষ মোটামুটি ভালো আছেন। তবে সেই অর্থে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়নি।’