প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন ঘিরে রংপুর নগরে এখন সাজ সাজ অবস্থা। সড়ক-মহাসড়ক ও দেয়াল ব্যানার, ফেস্টুন এবং তোরণে ছেয়ে গেছে। তার সফর ঘিরে আশায় বুক বেঁধেছেন তিস্তা পাড়ের মানুষজন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ায় মানুষের চাওয়া-পাওয়ায় আরও যোগ হয়েছে কয়েকটি নতুন দাবি। এর মধ্যে তিস্তা নদীর সুরক্ষা, বন্যা-ভাঙনরোধ, মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের জন্য মেগা প্রকল্প গ্রহণ ইত্যাদি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় সাড়ে চার বছর পর বুধবার (২ আগস্ট) রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিভাগীয় মহাসমাবেশে যোগ দিতে রংপুরে আসছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর রংপুরের দুটি উপজেলায় নির্বাচনি জনসভায় যোগ দিয়েছেন তিনি। জেলা স্কুলের মাঠে তৈরি করা হয়েছে সমাবেশের মঞ্চ।
তিস্তা পাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, এই অঞ্চলের মানুষের হাসি-কান্না, দুঃখ-দুর্দশার প্রধান পরিচায়ক তিস্তা নদী। এই নদীর পানি বণ্টন, ড্রেজিং, নদীশাসনসহ মহাপরিকল্পা গ্রহণ তাদের দাবি। কারণ প্রতি বছর নদীর দুই পাড়ে হাজার হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী কোথাও কোথাও হেঁটে পার হওয়া যায়। অথচ তিস্তা নদী ছিল বারোমাসি নদী। শুষ্ক মৌসুমেও অনেক পানি থাকতো। শুষ্ক মৌসুমে এই নদী পানিহীন হয়ে পড়লে অর্ধলক্ষাধিক জেলে-মাঝি কার্যত বেকার হয়ে পড়েন। এসব কারণে ভালো নেই তিস্তার দুই পাড়ের মানুষজন। তাই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
৬৫ বছরের হালিমা বেগমের বাড়ি ১৫ বার তিস্তায় ভেঙেছে। লালমনিরহাট সদর উপজেলার মেনেকা বেগম (৬০), গোলাপি রানি (২৮) ও করুন কান্তি রায়ের (৫৫) কয়েকবার বাড়ি ভেঙেছে। তাদের একটাই দাবি, আর ঘরবাড়ি হারাতে চান না। তাদের জন্য যেন কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে উন্নয়নের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী।
তবু এই নদী ঘিরেই স্বপ্ন দেখছেন তিস্তা পাড়ের বাসিন্দারা। চাষাবাদ করে ফসল ফলান, বিক্রি করে সংসার চালান। তুলনামূলক অনেক কম বাজার মূল্যেও তারা খুশি। তবে সবার কাছে আতঙ্কের নাম নদীভাঙন।
কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গেলো বছর মিষ্টি কুমড়া চাষে বিঘাপ্রতি ৬০ হাজার টাকা আয় করেছেন তিস্তা পাড়ের চাষিরা। ভুট্টা বিঘায় ৫০ মণ পর্যন্ত হয়েছে। আলু হয়েছে ১২০ মণের বেশি। এ ছাড়া আগাম জাতের ফসল চাষে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। সাফল্য দেখিয়েছেন চিয়া সিডসহ সব রকম দেশি-বিদেশি ফসল চাষে। সবমিলে শুধু ফসল চাষেই হাজার কোটি টাকার ওপরে আয় হয় চাষিদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তায় এখন পর্যন্ত গড়ে উঠেছে তিনটি সেতু ও একটি ব্যারাজ। অনেক ছোট-বড় সড়ক চলে গেছে নদীর বুক চিরে। সেতুকেন্দ্রিক বসেছে হাটবাজার, হয়েছে পার্ক। বিভিন্ন করপোরেট ও ব্যক্তি মালিকানায় খামার এবং প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এতে হুমকিতে রয়েছে জীববৈচিত্র্য। ২০১৭ সালে তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়া যেতো। পাঁচ বছর পর ২০২২ সালে দুটি ইলিশ পাওয়া যায়। এরপর ওই বছরের ৪ নভেম্বর তিস্তার কালিগঞ্জের ভোটমাড়িতে একটি ইলিশ পাওয়া যায়। এগুলোর প্রতিটির ওজন ৩০০-৫০০ গ্রাম। তবে এরপর থেকে আরও কোনও ইলিশ পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে, প্রতি বছরই তিস্তায় দেখা মেলে ডলফিনের। ২০২১ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচ মণ ওজনের একটি মৃত ডলফিন ভেসে ওঠে। পরে প্রশাসনের লোকজন ডলফিনটিকে মাটিচাপা দেন।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, ‘উজান থেকে প্রচুর পরিমাণ বালু এসে নদীর তলদেশ ক্রমেই স্ফীত হয়ে উঠেছে। এখন কোথাও কোথাও নদীর তলদেশ সমতল ভূমির চেয়ে অনেক উঁচু। এ জন্য মাছ ও জীববৈচিত্র্য কমে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘মহিষ ছেড়ে পালন করার জন্য উপযোগী তিস্তার চর। বদ্ধ ঘরের চেয়ে চরে পালন করলে জীবনমান ভালো থাকে প্রাণীর। চরকেন্দ্রিক সমবায়ভিত্তিক খামার করতে হবে। এক্ষেত্রে চরাঞ্চলের চারণ ভূমি দিতে সরকার বাধ্য। মহিষের সঙ্গে ভেড়া পালন সহজ। এতে খরচ কম হয়, লাভ বেশি থাকে।’
তিস্তার বাম তীর রক্ষা কমিটির দাবি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন অজুহাতে দামি জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলেছেন, যার আর্থিক মূল্য দিয়ে বাঁধ তৈরি করা যেতো।
তিস্তার বাম তীর রক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ সারওয়ার হায়াত খান বলেন, ‘আমার বাবার ৪৩ একর জমি তিস্তার গর্ভে চলে গেছে। মহাপরিকল্পনার বিষয়ে আমরা স্মারকলিপি দেবো। মূল প্রস্তাবনা হচ্ছে তিস্তা ঘিরে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে আমরা ধর্মঘটের ডাক দেবো। ডান ও বাম সব মিলিয়ে দুই কিলোমিটারের মধ্যে নদী রাখতে হবে।’
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বর্ষায় গড়ে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার কিউসেক পানি আসে তিস্তায়। এই পানি লালমনিরহাট অংশ দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে নদী নাব্যতা হারিয়েছে। নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ কিলোমিটার, যা দুই কিলোমিটার থাকার কথা। এই কারণে মূলত বন্যা ও ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের রংপুর বিভাগের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী এবার তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে যাবেন। এটি বহুল প্রতিক্ষিত দাবি আমাদের। নদীভাঙন শুরু হলে কিছু কাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শেষ হয়েছে। এটিকে একটি চ্যানেলে আনতে হবে। পর্যটন, কৃষি-কারখানা ও নৌ-চলাচলের উপযোগী করতে হবে। নদী হবে সর্বোচ্চ দুই কিলোমিটার। প্রতি বছর নদীভাঙনে ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। নদীর ওপর করপোরেট কোম্পানির নজর আছে। তারা জমি কম দামে কিনছে, দখল করছে। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপের ঘোষণার অপেক্ষায় আছি আমরা।’