পুণ্যস্নানকে ঘিরে তৎপর শিকারিরা!

রাসমেলা উপলক্ষে আসা তীর্থযাত্রীরা (ছবি: বাগেরহাট প্রতিনিধি)সুন্দরবনে সাগরের তীর ঘেঁষা দুবলার চরের আলোর কোলে রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে শুরু হয়েছে ‘পুণ্যস্নান’। আজ শনিবার (২৮ নভেম্বর) থেকে আগামী সোমবার (৩০ নভেম্বর) পর্যন্ত তিন দিন চলবে এই আয়োজন। করোনার কারণে অন্যান্য বছরের মতো তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থী না হলেও চলে এসেছে চোরা শিকারিরা। মৌসুমি শিকারি চক্র সুন্দরবনের হরিণ শিকারের সুযোগ নিতে তৎপরতা শুরু করেছে। তবে বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পুণ্যস্নান উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চোখ ফাঁকি দিয়ে শিকার করা সম্ভব হবে না।

প্রতি বছরের মতো কার্তিক মাসের শেষ বা অগ্রহায়ণের প্রথম দিকে শুক্লপক্ষের ভরা পূর্ণিমায় সুন্দরবনের দুবলারচরে তিন দিনব্যাপী রাস পূর্ণিমার পূজা ও পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হবে। এটি সব থেকে বড় সমুদ্র রাস উৎসব। তবে করোনার কারণে এবছর রাসমেলা হচ্ছে না।দুবলার চরে রাস পূর্ণিমা পুণ‌্যস্নান (ফাইল ছবি)

শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা শিক্ষক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অন্যান্য বছর হাজার হাজার পুণ্যার্থীর আগমনে মেলা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। এ মেলাকে কেন্দ্র করে সুন্দরবন উপকূলবর্তী মানুষের মধ্যে আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মেলায় যেতে আগে থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। তবে করোনার কারণে এ বছর হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া রাস উৎসবে অন্য কারও যাওয়ার অনুমতি না থাকায় উপকূলের হাজারো লোকের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।’

শ্যামনগরের পীযূষ বাওয়ালিয়া বলেন, ‘পূর্ণিমার জোয়ারে নোনা জলে স্নানের মধ্য দিয়ে পাপ মোচন হয় আর মনের কামনা পূর্ণ হয় এ বিশ্বাসে পুণ্যস্নানে যোগ দেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। তবে সময়ের ব্যবধানে এখন নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষ এখানে আসেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লঞ্চ, ট্রলার ও নৌকায় করে তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীরা সমবেত হন। আসেন অসংখ্য বিদেশি পর্যটকও। তবে এ বছর করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে রাসমেলার উৎসব বাতিল করা হয়েছে। পুণ্যার্থী ছাড়া দর্শনার্থী ও পর্যটকদের ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নদীপথে প্রবেশও করা হয়েছে নিয়ন্ত্রিত। ফলে দর্শনার্থী ও পর্যটক না এলেও মেলাকে সামনে রেখে চোরা শিকারি ও মৌসুমি শিকারি চক্রের সদস্যরা ঠিকই এসে পড়েছে। তারা সুন্দরবনের হরিণ শিকারের সুযোগ খুঁজছে। তাদের আগাম তৎপরতা দেখা গেছে।’সুন্দরবন

শ্যামনগরের গাবুরার আব্দুর রহিম ও বুড়িগোয়ালিনীর আব্দুল হালিম জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন আটটি উপজেলার চোরা শিকারি চক্র এই মুহূর্তে খুবই সক্রিয়। সুন্দরবনে প্রবেশে কড়াকড়ির মধ্যেও রাস পূর্ণিমার মেলাকে ঘিরে শিকারিদের হরিণ শিকারের প্রস্তুতি চলছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া এবারে পুণ্যস্নানে যাওয়ার অনুমতি না থাকায় অনেকেই জেলে সেজে রাস পূর্ণিমার প্রায় ১৫ দিন আগে থেকে দুবলার চরে অবস্থান করছে বলেও জানা গেছে। 

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী প্রকাশ ঘোষ বিধান বন বিভাগের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে ব্যাপক নিরাপত্তা গ্রহণ করা হলেও শ্যামনগর, কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, মোংলা, রামপালসহ উপকূলীয় এলাকার শিকারিরা উৎসব শুরু হওয়ার ১০/১৫ দিন আগে জেলে ও বনজীবী সেজে বিভিন্ন কৌশলে বনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে হরিণ শিকার করে। আবার পুণ্যস্নান শুরু হলে বিশেষ কায়দায় উপকরণ নিয়ে যাওয়া শিকারিরা তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে মিশে যায়। তারা দর্শনার্থী ও নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকারে মেতে ওঠে। ব্যাপক নজরদারি থাকা সত্ত্বেও শুধু হরিণ শিকারের উদ্দেশ্যে আসা এসব শিকারিকে আটকানো অনেক সময় সম্ভব হয় না।’সুন্দরবন

পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ বলেন, ‘তীর্থযাত্রীদের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ পাঁচটি পথ নির্ধারণ করেছে। এসব পথে তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের জানমালের নিরাপত্তায় বন বিভাগ, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর টহল দল নিয়োজিত থাকবে।’

অনুমোদিত পাঁচটি রুট হলো−বুড়িগোয়ালিনী, কোবাদক থেকে বাটুলানদী-বলনদী-পাটকোষ্টা খাল হয়ে হংসরাজ নদী হয়ে দুবলারচর। কয়রা, কাশিয়াবাদ, খাসিটানা, বজবজা হয়ে আড়ুয়া শিবসা-শিবসা নদী-মরজাত হয়ে দুবলার চর। নলিয়ান স্টেশন হয়ে শিবসা-মরজাত নদী হয়ে দুবলার চর। ঢাংমারী অথবা চাঁদপাই স্টেশন-তিনকোনা দ্বীপ হয়ে দুবলার চর এবং বগী-বলেশ্বর-সুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলার চর হয়ে দুবলার চর।সুন্দরবন (ছবি: মোংলা প্রতিনিধি)

তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ণিমা পুণ্যস্নানে কেবল তিন দিনের জন্য সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং মাস্কবিহীন কোনও তীর্থযাত্রীকে পুণ্যস্নানস্থলে যেতে দেওয়া হবে না। অনুষ্ঠানস্থলে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ডওয়াশ রাখা হবে।’

সুলতান আহমেদ জানান, তীর্থযাত্রীদের ২৮ থেকে ৩০ নভেম্বর এই তিন দিনের জন্যই অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রবেশের সময় এন্ট্রি পথে নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে। যাত্রীরা নির্ধারিত রুটের পছন্দমতো একটি মাত্র পথ ব্যবহারের সুযোগ পাবেন এবং দিনের বেলায় চলাচল করতে পারবেন। বনবিভাগের চেকিং পয়েন্ট ছাড়া অন্য কোথাও নৌকা, লঞ্চ বা ট্রলার থামানো যাবে না। প্রতিটি ট্রলারের গায়ে রং দিয়ে বিএলসি অথবা সিরিয়াল নম্বর লিখতে হবে। রাস পূর্ণিমায় আসা পুণ্যার্থীদের সুন্দরবনে প্রবেশের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে পাওয়া সনদপত্র সঙ্গে রাখতে হবে। পরিবেশ দূষণ করে এমন বস্তু, শব্দযন্ত্র বাজানো, পটকা ও বাজি ফোটানো, বিস্ফোরক দ্রব্য, দেশীয় যে কোনও অস্ত্র এবং আগ্নেয়াস্ত্র, হরিণ মারার ফাঁদ, কুড়াল, দড়ি বহন করা থেকে যাত্রীদের বিরত থাকতে হবে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অবস্থানকালীন সবসময় টোকেন ও টিকিট নিজের সঙ্গে রাখতে হবে। প্রতিটি লঞ্চ, নৌকা ও ট্রলারকে মেলা প্রাঙ্গণে কন্ট্রোলরুমে আবশ্যিকভাবে রিপোর্ট করতে হবে।