কেন ও কীভাবে ইতালি যাওয়ার বাসনা জেগেছিল:
উন্নত জীবনের আশায়, পরিবারকে সচ্ছল করার স্বপ্ন নিয়ে ১১ লাখ টাকা ঋণ করে ইতালি যাওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন ৪২ বছর বয়সী রাজ্জাক। দুই মেয়ে ও এক ছেলের এই পিতা ভেবেছিলেন, একবার ইতালি যেতে পারলে জীবন বদলে যাবে। উত্তর-প্রজন্ম নির্বিঘ্নে একটা জীবন কাটাতে পারবে। এজন্য বিভিন্ন এনজিও, সমিতি এবং স্বজনদের কাছ থেকে ধার করে জোগাড় করা হয় ওই ১১ লাখ টাকা। তারপর সেটি তুলে দেন দালাল রেবার হাতে। মাদারীপুরের এক স্বজনের মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এই রেবার। রেবাই তাকে ইতালিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। রেবার সঙ্গে আলাপ করেই বিদেশযাত্রার বাসনা পাকাপোক্ত হয় রাজ্জাকের মনে। বৃদ্ধ বাবা-মা ও স্ত্রী সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর আশায় রেবার পরামর্শে চূড়ান্তভাবে ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
যাত্রার শুরুতে দুবাই, তারপর মিসরে চার মাস বন্দি:
১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের আরও ৬৪ জনের সঙ্গে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে আরব আমিরাতের দুবাই প্রদেশের আজমান শহরে গিয়ে পৌঁছান রাজ্জাক। সেখান থেকে মিসরে নেওয়া হয় তাদের। দীর্ঘ চার মাস একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। সেই ঘরে বাংলাদেশি ৬৪ জন ছাড়াও মিসরের ১০ এবং মরক্কোর একজনসহ মোট ৭৫ জন ছিলেন। বাড়িতে ফোন করার কথা বললে বা কোনও কিছু চাইলেই সেখানে লিবিয়া প্রবাসী গোপালগঞ্জ জেলার মোকসেদপুর উপজেলার দালাল বুলেট ও মমিন তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতো। সেখানে প্রতি মাসে সাত লিটার পানি দেওয়া হতো তাদের প্রত্যেকের গোসল করার জন্য!
পেছনে বুলেটের ভয়, সামনে নির্জন পথ:
সাগর পাড়ে জাহাজে চড়ার কথা বলে চার মাস পর সেখান থেকে তাদের বের করে দেওয়া হয়। নির্জন বুনো, মেঠো ও কর্দমাক্ত, জলপথে হাঁটতে বলা হয়। অস্বীকৃতি জানালেই গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখানো হয়। বুলেটের ভয়ে ৬-৭ কিলোমিটার পথ দৌড়ে পাড়ি দিতে হয় তাদের। এরপর দেখা যায় সাগর পাড়। যেখানে জাহাজে চড়ার কথা, সেখানে গিয়ে দেখা যায় ৪০-৫০ জনের ধারণক্ষমতার একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা। সেই নৌকায় তোলা হয় ৭৫ জনকে।
‘এই বুঝি মারা গেছি’
সেদিনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বাংলা ট্রিবিউনকে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সাগরে প্রচণ্ড ঢেউ ছিল। যাত্রা শুরুর কয়েক ঘণ্টা পরেই তেল শেষ হয়ে যায় নৌকার। কোনও ধরনের খাবার ছিল না সঙ্গে। শুধু পানি খেয়ে দিন পার করেছি। খাবার না পেয়ে সবাই মৃত্যুর মুখোমুখি ছিলাম। ১৫-২০ ফুট উঁচু ঢেউ আসে একটু পরপর। মনে হয় এই বুঝি মারা গেছি। অনেকে রক্তবমি করেছে। অসহায় অবস্থা। প্রতিটা মুহূর্তে ছিল মৃত্যুর হাতছানি। কখনও ভাবিনি বৃদ্ধ বাবা-মা ও স্ত্রী সন্তানদের কাছে ফিরতে পারবো। ৬৪ ঘণ্টা এভাবেই ভেসে থাকি। এরপর একটি তেলের জাহাজ সাগর দিয়ে যেতে দেখি। আমরা সবাই ওই জাহাজকে হাত ইশারা করে ডাকার চেষ্টা করেছি এবং হেল্প, হেল্প, বাঁচাও, বাঁচাও বলে চিৎকার করেছি। পরে তিউনিসিয়ার ওই তেলবাহী জাহাজের লোকজন এসে আমাদের তাদের জাহাজে ওঠান। ওই জাহাজে ১৯ দিন কেটে যায়।
কেমন যাবে অনাগত দিনগুলো:
প্রাণ নিয়ে ফেরায় স্বস্তি আছে। তবে ঋণ নেওয়া ১১ লাখ টাকা শোধ করার কথা মনে হলে আবারও শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এখন কী করে এই টাকা শোধ করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না রাজ্জাক। তিন ভাই-বোনের মধ্যে একমাত্র পুত্রসন্তান আব্দুর রাজ্জাক সবার বড়। বাবা টঙ্গীর চেরাগ আলী এলাকার কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলে চাকরি করতেন। অভাবের সংসার হওয়ায় রাজ্জাকের শিক্ষা স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি। ২০০২ সালে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার বৃদ্ধ বাবা বেকার হয়ে পড়েন। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। এলাকাতেই ছোট্ট একটি মুদি দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ভালোই চলছিল তার ব্যবসা। এরমধ্যেই ইতালি যাওয়ার ভূত এলোমেলো করে দিয়ে গেছে সবকিছু। এ ব্যাপারে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দালাল রেবার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।’ এই ঋণের বোঝার কথা চিন্তা করে পরিবারের অন্যরাও ভেঙে পড়েছেন।