উন্নয়নশীল বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি রাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন নাকি বাজার নেতৃত্বাধীন নীতির মাধ্যমে হবে– তা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। যেখানে নিউলিবারেল ধারণা বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে, সেখানে মারিয়ানা মাজুকাতোর ‘উদ্যোক্তা রাষ্ট্র’ ধারণাটি একটি বিকল্প কাঠামো প্রদান করেছে। এই মডেলের আওতায় রাষ্ট্র কেবল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় সীমাবদ্ধ না থেকে উদ্ভাবন ও শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে সক্রিয় ও ঝুঁকি গ্রহণকারী শক্তি হিসেবে কাজ করে। এটি বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বেসরকারি খাতের সক্ষমতা তুলনামূলক সীমিত এবং দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা ও উদ্ভাবনে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ অপরিহার্য।
‘উদ্যোক্তা রাষ্ট্র’ ধারণা অনুযায়ী, সরকার কেবল নীতিনির্ধারক নয়, বরং প্রযুক্তি ও শিল্প বিকাশের চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মডেলটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ দেশটির বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) খাত এখনও দুর্বল এবং অর্থনীতি প্রধানত তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের মতো দেশগুলো সরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কৌশলগত শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করেছে।
বাংলাদেশও যদি এই কৌশল অনুসরণ করে, তবে পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফার্মাসিউটিক্যালস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং তথ্য-প্রযুক্তির মতো উচ্চমূল্যের শিল্প খাতের বিকাশ ঘটাতে পারে।
বৈপ্লবিক উদ্ভাবনের মূল উৎস প্রায়ই সরকারি বিনিয়োগ, কারণ বেসরকারি খাত সাধারণত উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল গবেষণা এড়িয়ে চলে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে, যেখানে বেসরকারি খাতের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা সীমিত, সেখানে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO)-এর মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগ উপগ্রহ প্রযুক্তি ও দূর অনুধাবন খাতকে ব্যাপকভাবে উন্নত করেছে, যা কৃষি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন খাতকে সহায়তা করছে। একইভাবে ব্রাজিলের রাষ্ট্রীয় কৃষি গবেষণা সংস্থা (EMBRAPA) দেশটিকে বিশ্বব্যাপী কৃষি খাতে শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই মডেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাজারচালিত অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা ও উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সীমিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান স্বল্পমেয়াদি লাভকে অগ্রাধিকার দেয়, ফলে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ তুলনামূলক কম। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে বাজার ব্যর্থতার সংশোধন করতে হবে এবং উচ্চ-প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো, বাংলাদেশও কৌশলগত ভর্তুকি ও গবেষণা অনুদান প্রদান করে ইলেকট্রনিক্স, কৃষি-প্রযুক্তি এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুঁজি বাজারের দুর্বলতা, সীমিত প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং অপর্যাপ্ত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ব্যবস্থা শিল্পোন্নয়নকে ব্যাহত করে। রাষ্ট্র এই ব্যবধান দূর করতে পারে সরকারি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গঠন এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প খাতের মধ্যে কার্যকর সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে।
চীনের টেকসই প্রযুক্তি খাতে সাফল্য এটির একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি, সরকারি সহায়তা ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর মাধ্যমে চীন বৈশ্বিক সৌর প্যানেল ও ব্যাটারি উৎপাদনের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অনুরূপভাবে, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোও উচ্চ-প্রযুক্তি শিল্পের দিকে অগ্রসর হতে পারে, যদি তারা পরিকল্পিতভাবে সরকার নেতৃত্বাধীন শিল্পনীতি গ্রহণ করে।
পাশাপাশি, উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সরকার উচ্চমাত্রার ঝুঁকি নিলেও, এর অর্থনৈতিক সুফল প্রধানত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভোগ করে। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো (MNCs) স্থানীয় সম্পদ ও প্রযুক্তি আহরণ করলেও, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে না। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এ ধরনের বৈষম্যের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সরকারি প্রণোদনা ও অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এই খাতকে বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক করা হলেও অধিকাংশ লাভ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের হাতে চলে যায়, আর শ্রমিকরা তুলনামূলক কম সুবিধা পেয়ে থাকে। এ কারণে, রাষ্ট্রকে এমন নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে যাতে উদ্ভাবন ও গবেষণা খাতে সরকারি বিনিয়োগের সুফল জনগণের মধ্যেও সুষমভাবে বণ্টিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সরকার গবেষণা ও উন্নয়নের সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানায় অংশগ্রহণ করতে পারে, যাতে ভবিষ্যৎ মুনাফার একটি অংশ জনকল্যাণে ব্যবহার করা যায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে বিনিয়োগে বাধ্য করা এবং রাষ্ট্র-সমর্থিত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড গঠনের মাধ্যমেও উচ্চ-প্রযুক্তি খাতকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
এর বিপরীতে, যেসব উন্নয়নশীল দেশ ল্যাসেজ-ফেয়ার (laissez-faire) অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণ করেছে—প্রায়ই আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপের ফলে—তারা পণ্যনির্ভরতা ও নিম্ন-মূল্য সংযোজন শিল্পের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে, ‘উদ্যোক্তা রাষ্ট্র’ মডেল গ্রহণের মাধ্যমে এসব দেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রতিকূল শর্তে নিছক সংযুক্ত হওয়ার পরিবর্তে সক্রিয়ভাবে নিজেদের অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠন ও বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে।
যদিও ‘উদ্যোক্তা রাষ্ট্র’ মডেলের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এটি বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে ব্যাহত করতে পারে। তাই সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে যে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ যেন কৌশলগত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হয়। এছাড়া, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্য চুক্তিগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিল্পনীতি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই কৌশলগত নীতিনির্ধারণ, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং কার্যকর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তদ্রূপ, বাংলাদেশকে শাসনব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, যাতে অদক্ষতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যায়। স্বচ্ছ সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা, স্বাধীন নজরদারি সংস্থা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন, যাতে সরকারি বিনিয়োগগুলো কৌশলগত ও জবাবদিহিমূলক হয়।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) নিয়মাবলি বাংলাদেশের শিল্পনীতি বাস্তবায়নের সক্ষমতাকে সীমিত করতে পারে। সতর্কতার সঙ্গে আলোচনা ও আঞ্চলিক সহযোগিতা (যেমন, দক্ষিণ এশীয় বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে) রাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন উদ্যোগগুলোর জন্য নীতিগত সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
‘উদ্যোক্তা রাষ্ট্র’ মডেল উন্নয়নশীল বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী কাঠামো প্রদান করে। রাষ্ট্রকে উদ্ভাবনের চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে উন্নয়নশীল দেশগুলো বৈদেশিক বিনিয়োগ ও নিম্ন-মূল্যের শিল্পের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে অগ্রসর হতে পারে। গবেষণা ও উন্নয়নে কৌশলগত সরকারি বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং শিল্পনীতির মাধ্যমে উচ্চ প্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ সম্ভব।
যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে পূর্ব এশিয়া, ভারত ও ব্রাজিলের সাফল্য প্রমাণ করে যে ‘উদ্যোক্তা রাষ্ট্র’ মডেল কেবল সম্ভাবনাময় নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
লেখক: লোক-প্রশাসন এবং জননীতি গবেষক।