ফুটবলের উন্নয়নে প্রবাসী ফুটবলারই কি একমাত্র সমাধান?

১৭ থেকে ২৫ মার্চ এক হামজা ঝড় শুধু ক্রীড়াঙ্গন নয়, পুরো বাংলাদেশকে একেবারে ওলটপালট  করে গেলো। এক পলকে বাংলাদেশের মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলো ফুটবল, যা গত ২০ বছরে ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার। কারণ একটাই– বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার যে ফুটবলের আঁতুড়ঘর ইংল্যান্ডের ক্লাব কাঠামোর সর্বোচ্চ স্তরে খেলেছে, শিরোপা জিতেছে এবং ইংল্যান্ডের বয়সভিত্তিক দলেও খেলেছেন, তিনি এখন বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলতে এসেছেন।

ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ স্তরে এখন ২১১টি দেশের মধ্যে ১২০তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পতাকাটাও উজ্জ্বলভাবে শোভা পাচ্ছে, যেখানে স্থান পাইনি ভারত। এই হামজা জোয়ারে বাংলাদেশের ফুটবল কত এগিয়ে যাবে, এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
 
ফিফা এমন প্রতিষ্ঠান যে গত ১০০ বছর ধরে সফলতার সঙ্গে পরিচালনা হচ্ছে। একটা প্রতিষ্ঠান তখনই বিশ্বের সবকটি দেশে এত সময় ধরে সুন্দরভাবে প্রভাব বিস্তার করে, যখন তার প্রপার সিস্টেম থাকে, যা সবার জন্য সমান। ফিফার এই সিস্টেম বিশ্বের সব নামিদামি স্পোর্টসের আইনজীবী দিয়ে সময়োপযোগীভাবে তৈরি।

এ কারণে নিয়মগুলো এতই  সুদৃঢ় যে যত বাধা-বিপত্তি আসুক না কেন, এই ফুটবল খেলা বিশ্বের সবচেয়ে পছন্দের খেলায় পরিণত হয়েছে। ফিফার নিয়ম আমেরিকা ইংল্যান্ডের জন্য যা, বাংলাদেশের জন্যও সেই সমান। কিন্তু তা নিয়ে আপনি কীভাবে আপনার দেশের ফুটবল সাজাবেন তা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আপনার দেশের ওপর।

ফেডারেশনে কাজ করা মানুষগুলো যদি নিয়ম-কানুন বুঝে এগিয়ে যান তবে সেই দেশের ফুটবল উন্নত হয়।  নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মানুষের ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা বিশ্বের অন্যান্য যেকোনও দেশের থেকে বেশি কিন্তু ফুটবলের নিয়ম বুঝে ফুটবলকে পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের  অবস্থান  তলানিতে, ২১১-এর মধ্যে ১৮৩।

৫০-৬০ বছর আগেও পৃথিবীর মানুষ জীবিকার তাগিদে অন্য দেশে থিতু হয়ে যাওয়ার সংখ্যা বেশি ছিল না। কিন্তু গত ২০-৩০ বছর ধরে পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ উন্নত জীবনের খোঁজে অন্য প্রান্তে ছুটে গেছে এবং সেখানেই নাগরিকত্ব লাভ করেছে। এছাড়াও অনেকে ভিন্ন দেশি মানুষের সঙ্গে বিবাহের সূত্রে নাগরিকত্ব লাভ করেছে। এর জন্য তাদের পরবর্তী জেনারেশন জন্মের পর থেকেই সেই দেশের নাগরিক, আবার বাবা-মায়ের জন্ম সূত্রে অন্য দেশেরও নাগরিকত্ব লাভ করেছে। এতে পুরো বিশ্বেই নতুন জেনারেশনে দ্বৈত নাগরিকত্বের মানুষের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

ফিফার নজরে এসেছে যে অনেক ভালো কোয়ালিটির ফুটবল প্লেয়ার জাতীয় দলের খেলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফিফা সবসময়ই প্লেয়ারদের জন্য সবচেয়ে বেশি আন্তরিক এবং এর জন্যই বিশ্বের সেরা আইনজীবীদের দিয়ে একটি নীতি প্রণয়ন করেছে। একজন প্লেয়ার যার দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে সে তার পছন্দের দেশের জাতীয় দলের খেলার সুযোগ তৈরি করে নিতে পারবে। এই নীতি ফিফা পাস করেছে ১৮ সেপ্টেম্বর  ২০২০ সালে। ফিফার অন্য যেকোনও নিয়মের চেয়ে এই নিয়ম তুলনামূলকভাবে নতুন এবং এই নীতি সব দেশ এখনও বুঝে ওঠার জন্য পরিপক্ব হয়ে ওঠেনি। যার জন্য এখনও এই নীতি নিয়ে অনেক দেশেরই মধ্যে ধোঁয়াশা আছে এবং যার কারণে খেলার অনুমতি পেতে সময় লেগে যায়।
 
প্রবাসী ফুটবলের আবির্ভাব বাংলাদেশে সেই ২০১৩ সালে জামাল ভূঁইয়ার মাধ্যমে কিন্তু তখন নিয়ম-নীতির এত সরু রাস্তা ছিল না। কালের পরিক্রমায় রিয়াসাত খাতন (২০১৩), জোসেফ নুর রহমান (২০১৫) ও বিশাল দাস (২০১৮) বাংলাদেশে খেলার জন্য এসেছিলেন, কিন্তু তারা সেভাবে জাতীয় দলে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিতে পারেনি। ২০১৯-২০২০ সালের মধ্যে বসুন্ধরা কিংসের হাত ধরে বাংলাদেশ আবির্ভাব ঘটে তারেক কাজী, মাহাদী খান ও নবাব  রহমানের। এর মধ্যে তারেক কাজী একমাত্র বাংলাদেশ জাতীয় দলের একাদশের জায়গা করে নেন এবং নবাব রহমান জাতীয় দলে ডাক পেলেও শেষ পর্যন্ত তার একাদশে জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ হয়নি।
 
২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশের ‘জামাই’ নামে খ্যাত এলিটা কিংসলে শত বাধা উপেক্ষা করে বসুন্ধরা কিংসের সাহায্যে নাইজেরিয়ান পাসপোর্ট ত্যাগ করে বাংলাদেশের পাসপোর্ট জোগাড় করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে পারমিশন পেতে সময় লেগে যায়। পরে যখন সময় আসে তখন ফিটনেস ঘাটতির জন্য জাতীয় দলের একাদশে সুযোগ নিয়মিত হয়নি।

গত ১৭ মার্চ হামজা চৌধুরী আগমনকে ঘিরে যে উন্মাদনা ফুটবলকে নিয়ে তৈরি হয়েছে তা দেখে অনেক বংশোদ্ভূত প্লেয়ার, যারা কিনা আগে আগ্রহ ছিল না তারা এখন জাতীয় দলের খেলার বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করছেন। এর ফলে বাফুফে  জুন মাসে বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত প্লেয়ারদের জন্য একটি  বিশেষ ট্রায়ালের সুযোগ করে দিচ্ছে।

বাফুফের উদ্দেশ্য এই ট্রায়াল থেকে যত সম্ভব খেলোয়াড়কে বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক এবং জাতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এই ঘোষণার পরেই বাংলাদেশের ফুটবল মহলে পক্ষে এবং বিপক্ষের অনেক যুক্তি উঠেছে, যাতে পুরা বিষয়টি নিয়ে একটি ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে যে বংশোদ্ভূত প্লেয়ার অন্তর্ভুক্তি দেশের ফুটবলের উন্নয়ন করবে কিনা।

বর্তমান সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আফ্রিকার বিভিন্ন প্লেয়ারকে খেলতে দেখা যায়, যারা সেই দেশে ফুটবল কাঠামো থেকে বড় হয়ে উঠে এসেছে। যেমন, ফ্রান্সের ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড কাপ স্কোয়াডে ২৩ জনের মধ্যে ২০ জন প্লেয়ারই ছিল অভিবাসী প্লেয়ার, যারা কিনা সেই দেশে ফুটবল কাঠামোতে বড় হয়েছিল। পল পগবা বা এবং এমবাপ্পে এর মধ্যে অন্যতম। আগে ১৯৯৮ সালের ওয়ার্ল্ড কাপ জয়ী ফ্রান্স দলের প্লেয়ার জিদান বা প্যাট্রিক ভিয়েরা চাইলে যথাক্রমে আলজেরিয়া এবং সেনেগালের হয়ে খেলতে পারতেন। আবার অনেক সময় ইউরোপের অনেক দেশের প্লেয়ারকে আফ্রিকাতে তার বাবা-মায়ের দেশকে বেছে নিতে দেখা যায়।

 ২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড কাপে তাক লাগিয়ে দেওয়া মরক্কো স্কোয়াডের হাকিম জিয়েচ এবং আশরাফ হাকিমি যথাক্রমে নেদারল্যান্ড এবং স্পেনের হয়ে খেলতে পারতেন।
 
এছাড়াও নামকরা প্লেয়ার রিয়াদ মাহারেজ চাইলে ফ্রান্সের হয়ে খেলতে পারতেন, কিন্তু তিনি তার বাবা-মায়ের দেশ আলজেরিয়ায় হয়ে খেলেন। এরকম দুই পাশেরই  বিভিন্ন উদাহরণ দেখা যায়। অনেক সময় এমনও দেখা গিয়েছে যে একজন প্লেয়ার যখন জাতীয় দলে খেলার পর যখন সুযোগ পাচ্ছিল না, তখন অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে সেই জাতীয় দলের খেলার সুযোগ সৃষ্টি করে সেখানে এখন নিয়মিত খেলছেন। যেমন, ব্রাজিলের ডিয়াগো কস্তা ২০১৩ সালে ব্রাজিলের দুটি ম্যাচ খেলার পরও ২০১৪ সালে স্পেনে যোগদান করেন এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৪টি ম্যাচ খেলেন।

ফ্রান্সের আইমেরিক লাপরতে ২০১১ সাল থেকে ফ্রান্সের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলার পরও যখন জাতীয় দলের সুযোগ পায়নি তখন ২০২১ সালে তিনি স্পেনের নাগরিকত্ব অর্জন করেন এবং এখন পর্যন্ত স্পেনে ৪০টি ম্যাচ খেলেছেন।

গত কয়েক বছরে এরকম বেশ কিছু উদাহরণ দেখা গেছে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়। আবার কিছু ক্ষেত্রে ফুটবলে সাফল্যের আশায় জোরপূর্বক নাগরিকত্ব দিয়ে জাতীয় দলের মান উন্নয়ন করতে গিয়ে সে দেশের ফেডারেশনকে ফিফা নিষেধাজ্ঞায় পড়তে দেখা গিয়েছে। ২০১৭ সালে পূর্ব তিমুর ফুটবল ফেডারেশন ১২ জন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারকে কাগজ জালিয়াতির মাধ্যমে সে দেশের নাগরিকত্ব দিয়ে ফুটবল খেলিয়েছিল, যা ফিফার নজরে আসে। পরে ফিফা এবং এফসি তাদের সাময়িক সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। বংশোদ্ভূত প্লেয়ার নিয়ে ভালো এবং খারাপ উভয় রকম ঘটনা বিশ্বজুড়ে ফুটবলে গত ১০ বছরে  ঘটতে দেখা গেছে।
 
লেখার শুরুতেই ফিফার যে বলিষ্ঠ নিয়মনীতি নিয়ে বলছিলাম, সেই নীতির মাধ্যমে ফিফা সবার আগে প্রাধান্য দিয়েছে দেশের ফুটবল কাঠামোকে। যেই কাঠামোকে ঘিরে ফুটবলার গড়ে উঠবে এবং তারা জাতীয় দলে প্রাধান্য দিয়ে থাকবে, ফ্রান্সের মতো। এতে জাতীয় দলের প্লেয়াররা সেই দেশ এবং দেশের সম্মানকে বুকে ধারণ করে দেশের জন্য মাঠে উজাড় করে দেবেন। দিনশেষে একটা দেশের ফুটবল কাঠামো থেকে উঠে আসা ফুটবলারদের দায়িত্ব হচ্ছে সে দেশের ফুটবলটাকে উপরের দিকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

ফিফা সবসময় উদ্বুদ্ধ করে যেন একটা দেশে সঠিক ফুটবল কাঠামো থাকে। বর্তমান সময়ের চাহিদার জন্য ফিফা  বংশোদ্ভূত প্লেয়ারদের সুযোগ করে দেয়। কিন্তু এই নতুন নীতি কখনোই ফিফার কাছে তার মূলনীতি থেকে বেশি প্রাধান্য পাবে না, যার কারণে এই নতুন নীতিতে তারা অনেক যদি-কিন্তু ধারা-উপধারা দিয়েছে, যা পূরণ করে অন্য একটি দেশের জন্য খেলতে গেলে অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। কারণ ফিফাও জানে যদি অন্য দেশের অবকাঠামো থেকে উঠে আসা একটা প্লেয়ার সহজে আরেকটা দেশে খেলতে পারে তাহলে কোনও দেশই তার ফুটবলের কাঠামোর দিকে নজর দিবে না। তারা এই আশায় থাকবে যাতে বংশোদ্ভূত প্লেয়ার দিয়ে জাতীয় দল গঠন করা যায় এবং দ্রুত সাফল্য অর্জন করা যায়।

লেখা শেষ করার আগে বলতে চাই, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ফুটবল কাঠামো থেকে উঠে আসা ফুটবল প্লেয়াররা হচ্ছে আমাদের ‘নেসেসিটি’ আর বংশোদ্ভূত প্লেয়াররা হচ্ছেন ‘লাক্সারি’।

জীবনের ‘নেসেসিটি’ আর ‘লাক্সারি’ দুটোরই দরকার আছে কিন্তু শুধু ‘নেসেসিটি’ দিয়েও জীবন চলে না আবার শুধু ‘লাক্সারি’ দিয়েও জীবন চলে না। নেসেসিটি এবং লাক্সারির মধ্যে যে পার্থক্য বোঝা এবং সমন্বয় করা খুবই জরুরি। তাই প্রবাসী ফুটবলার বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নে একমাত্র সমাধান নয়।

বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নে ফুটবল ফেডারেশনকে ফুটবল কাঠামো নিয়ে কাজ করতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে কোয়ালিটি প্রবাসীদের সংযুক্ত করতে হবে। কিন্তু শুধু প্রবাসীদের সংযুক্তির মাধ্যমে ফুটবলের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ফিফা রোডম্যাপ অনুযায়ী ফুটবল বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে, সেখানে ফুটবল কাঠামোটাতে নজর না দিলে বাংলাদেশের ফুটবল কোনোদিনই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে শুধু প্রবাসী ফুটবলার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সাময়িক একটা সাফল্য পেলেও ভবিষ্যতে ফুটবলটা আবার সেই মুখ থুবড়ে পড়বে, যেভাবে ৯০-এর দশকে ফুটবলটা মুখ থুবড়ে পড়েছিল একটি সুন্দর কাঠামোর অভাবে।

 লেখক: মার্কেটিং অ্যান্ড মিডিয়া ম্যানেজার, বসুন্ধরা কিংস।