পহেলা বৈশাখ হোক ঐক্যের প্রতীক, বিভক্তির নয়!

পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের একটি প্রারম্ভনা হলেও এই দিনটি উদযাপনের রয়েছে নানান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য। একথা অনস্বীকা‍র্য যে, আধুনিক নগর আধিপত্যবাদী জীবনাচারের ভেতর দিয়ে ইংরেজি পঞ্জিকা আমাদের নিত্যদিনের জীবনকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, পরিচালিত করে এবং রেগুলেট করে, সেখানে বাংলা সনের ব্যবহারি গুরুত্ব ও প্রায়োগিত তাৎপর্য খুব একটা বেশি নেই।

কেননা আমাদের সবকিছুই ইংরেজি পঞ্জিকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একেবারে শিক্ষা কা‍র্যক্রম থেকে শুরু করে চাকরির বাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিত্যদিনের জীবন, সব ধরনের দিন-তারিখ নি‍র্ধারণ, গুনাগুণির কাজ, কিংবা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনা... সবকিছুই ইংরেজি পঞ্জিকার হিসাব অনুযায়ী পরিচালিত হয়। ফলে, দিন, তারিখ বা সনের ব্যবহার বিবেচনায় বাংলা সনের পঞ্জিকার আমাদের জীবনে খুব একটা অর্থবহ উপস্থিতি নাই বললেই চলে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, যেহেতু বাংলা মাসের কোন গুরুত্ব, তাৎপর্য, কার্যকারিতা এবং উপযোগিতা আমাদের নিত্যদিনের জীবনে নাই, সেহেতু বাংলার সন-তারিখ নিয়ে আমাদের এত মাতামাতি করার কিছু নাই।

আমি বরঞ্চ উল্টোভাবে ভাবতে চাই। যেহেতু আমাদের জীবনে ইংরেজি পঞ্জিকা সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করে, কা‍র্যত সবকিছুকেই দখল করে নিয়েছে, বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে বসবাস করা সত্ত্বেও বাংলা পঞ্জিকা আমাদের জীবনে কোনও গুরুত্বই বহন করে না, সেহেতু অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এবং মহা ধুমধামের সাথে বাংলা বছরকে উদযাপন করা আমাদের জন্য একটা অতিরিক্ত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায় ও দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে অন্তত একদিনের জন্য হলেও আমরা যেন আমাদের নিজেদের সত্তার, নিজেদের পরিচয়ের এবং নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের মুখোমুখি দাঁড়াই।

আমরা যেন এটাকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির এবং আমাদের স্বকীয় সত্তার একটা মোকা হিসাবে গ্রহণ করি এবং এ দিনটিকে ব্যবহার করে উত্তর প্রজন্মের সামনে আমরা যেন বাঙালির হাজার বছর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের একটা তাৎপর্য উপস্থাপন করি।

পহেলা বৈশাখ ব্যক্তি পর্যায়ে, পারিবারিক আবহে, সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করা উচিত যার মধ্য দিয়ে আমরা যেন নিজেদের স্বকীয় সত্তার একটা উদ্বোধন করতে পারি নতুন প্রজন্মের কাছে। আমরা যেন সবার সামনে বাঙালি জাতি ও জাতিসত্তার গুরুত্ব উপস্থাপন করতে পারি। এবং বিশ্ব দরবারের কাছে বাঙালি সংস্কৃতি উত্তরাধিকারের সমৃদ্ধ গৌরবগাঁথা এবং তাৎপর্যকে যেন আমরা পরিবেশন করতে পারি।

আমাদের সমাজে নানান ধরনের বিভক্তি জারি আছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে, জাত-পাতের ভিত্তিতে, ধ‍‍র্ম-ব‍‍র্ণের ভিত্তিতে, অর্থনৈতিক সক্ষমতার ভিত্তিতে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ভিত্তিতে নানান ধরনের মত-পথের মানুষ এই সমাজে একত্রে বাস করে। ফলে, একটি বিষয়কে এক একজন এক একভাবে দেখে বলেই আমরা কোন বিষয়ে সার্বজনীন কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি না। সব বিষয়ে একমত হতে না-পারাটা ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাস্থ্যকর যতক্ষণ এ ভিন্নতা এবং মতপা‍র্থক্য পরস্পরের ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি না-হয়ে ওঠে। এই মতপার্থক্যটা ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাস্থ্যকর যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই, ভিন্ন আদর্শের প্রতি সহনশীল হই এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহমর্মী হই; কিন্তু নানান ভিন্নতা থাকলেও আমরা সবাই বাঙালি (আদিবাসীদের কথা বাদ দিয়ে পড়ুন); আমাদের একটা সামাজিক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আছে; আমরা হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাই আজকে এখানে এসেছি;  এই বিষয়গুলোতে মত ভিন্নতার খুব একটা পরিসর থাকে না।

তাই, পহেলা বৈশাখ দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের সকল সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় বিদ্যমান মানুষের মধ্যে একটা সার্বজনীন উৎসবের চেহারা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হবে এটাই কাম্য। কেননা পহেলা বৈশাখ আমাদের সাংস্কৃতিক সত্তার স্মারক; পহেলা বৈশাখ আমাদের অস্তিত্বের প্রতীক; পহেলা বৈশাখ আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা; এই জায়গা গুলোতে আমরা যেন নিজেদেরকে দ্বিধা বিভক্ত না-করি; আমরা যেন শত ভিন্নতা সত্বেও পহেলা বৈশাখকে এবং এর যে সামাজিক সাংস্কৃত দার্শনিক ভিত্তি তাকে বিতর্কিত না-করি।

আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন বিশ্বায়নের হাত ধরে বিজাতীয় সংস্কৃতি আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নানানভাবে তাদের মানসপাটে একটা ভিন্ন জীবন দর্শনের পাটাতন তৈরি করছে। এবং অতিমাত্রায় বিজাতীয় সংস্কৃতিতে আসক্ত হওয়ার কারণে নিজের সংস্কৃতি, সংস্কৃতি সত্তা ও সাংস্কৃতিক উপযোগিতাকে ভুলে যাওয়ার উপলক্ষ তৈরি করছে, তখন অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে পহেলা বৈশাখের মতো অনুষ্ঠান পালন করা আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। আজকের প্রজন্মের মধ্যে যদি বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারা আমরা সঞ্চারিত করতে না পারি তাহলে এই সংস্কৃতি এবং তার যে প্রবাহমান প্রবণতা তার বিকাশ ও সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে হুমকির মধ্যে পড়বে।

আমাদের রাজনৈতিক বিভক্তি, রাজনৈতিক মত-ভিন্নতা এবং দলীয় রাজনৈতিক দর্শনের করাত দিয়ে আমরা যেন পহেলা বৈশাখ কেন্দ্রিক যে আনুষ্ঠানিকতা, যে সংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা তাকে যেন কর্তন না-করি। আমরা জানি কোনও কিছুই রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয় কিন্তু রাজনীতিকীকরণের মাত্রা আমরা কতটুকু সহনশীলতার মাপকাঠিতে রাখতে পারব তার ওপর নির্ভর করছে এ বিভক্তি সার্বজনীন সংস্কৃতি কেন্দ্রীক বিত‍‍র্ক, আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূলে কতোটা আঘাত কবরে কিংবা করবে না। 

তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা নাকি আনন্দ শোভাযাত্রা এই ধরনের বিতর্কগুলোকে আমরা সামনে নিয়ে এসে নতুন প্রজন্মের সামনে আমরা আসলে কি উপস্থাপন করছি? সত্যিকার অর্থে আনন্দ শোভাযাত্রা আর মঙ্গল শোভা যাত্রার মধ্যে মৌলিক কোনও দার্শনিক এবং সমাজতাত্ত্বিক পার্থক্য কি আছে?  অমঙ্গলকে দূর করে মানুষের মঙ্গল কামনা করা, সমাজে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মঙ্গল কামনা করার দর্শনে দীক্ষিত যে মঙ্গল শোভাযাত্রা সেটাকে আনন্দ শোভাযাত্রা করে আদৌ কি আমরা মৌলিক কোন পরিবর্তন এনেছি? ফলে এই ধরনের অর্থহীন বিতর্কের ভিতর দিয়ে আমাদের ইতোমধ্যে বিভক্ত সমাজকে আর নতুন বিভক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছি কিনা সেটা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে ধর্ম, বর্ণ, দর্শন, রাজনৈতিক মতাদ‍‍র্শ ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হতে পারে কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে আমাদের যে সার্বজনীন সাংস্কৃতিক সত্তা সেটাকে যেন আমরা বিতর্কিত না করি; সেটাকে যেন আমরা বিভক্ত না করি এবং সেটাকে যেন আমরা উত্তর প্রজন্মের কাছে বিভ্রান্তিকর কোনও বিষয় হিসেবে উপস্থাপন না-করি।

একটা রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। অনেক স্বপ্ন, অনেক প্রত্যাশা এবং অনেক আশা নিয়ে যারা দেশকে ভালোবেসে বুক বেঁধেছিলেন, তারা যেন কোনও কারণেই হতাশ না-হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতির যে বিভক্তি এবং সর্বক্ষেত্রে রাজনীতিকীকরণের যে একটা অসুস্থ চর্চা জারি আছে, সেখান থেকে বেরিয়ে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সামনে উপস্থাপিত হবে, এটাই সবার কাছে প্রত্যাশিত। এই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম পহেলা বৈশাখ উদযাপন হবে মহা ধুমধামে এবং দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ উৎসব একটি সা‍র্বজনীন চরিত্র ধারণ করবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এই পহেলা বৈশাখের প্রধান আনুষ্ঠানিকতা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে চারুকলা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মতপার্থক্য এবং এটাকে কেন্দ্র করে নানান ধরনের সংবাদ সম্মেলন ও পক্ষ-বিপক্ষে অবস্থান এই পহেলা বৈশাখের উদযাপনের অনুষ্ঠানিকতাকে এবং এর যে একটি সা‍র্বজনীন সত্তা সেটাকে খানিকটাও হলেও ম্লান করেছে।

আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে এতটুকু বিতর্ক তৈরি না করেও পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতাকে সার্বজনীন করা যেত। এই বিতর্ক তৈরি করে কার কী লাভ হয়েছে সেটা আমি জানি না কিন্তু পহেলা বৈশাখের যে সার্বজনীন সত্তা এতে খানিকটা খাটো হয়েছে এবং ম্লান হয়েছে যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রত্যাশিত ছিল।

বিশেষে বলবো, আমরা চাই দলীয় রাজনীতি এবং রাজনৈতিক মত-ভিন্নতার কারণে  যেন সার্বজনীন সংস্কৃতি সত্তাকে, এবং সার্বজনীন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে আমরা আঘাত না-করে। অন্তত পহেলা বৈশাখের মতো বাঙালি সংস্কৃতির, বাঙালি জাতিসত্তার এবং বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের একটি অন্যতম মৌলিক আনুষ্ঠানিকতাকে যেন আমরা আমাদের রাজনৈতিক মত-ভিন্নতার এবং মতাদর্শিক দলাদলি হাত থেকে মুক্তি দিই। একটা মুক্ত আবহাওয়ায় পহেলা বৈশাখ পালিত হোক এটা আমরা সকলেই প্রত্যাশা করি। সবাইকে বাংলার নববর্ষ ১৪৩২ এর আন্তরিক শুভেচ্ছা।

লেখক: ভিজিটিং স্কলার, হা‍র্ভা‍র্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অধ্যাপক , নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।