করদাতারা সুরক্ষা পেলে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে

বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সব জায়গায় চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের গোলটেবিলে বা ছোট্ট কুটির থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল/ শেরাটন বা সোনারগাঁয়ের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রুমের কোট-সুট পরা ভদ্রলোক বা দিনমজুর শ্রমিক বা রিকশাচালক কিংবা বাসের হেল্পারসহ নানান পেশার মানুষের মুখে মুখে বা গলাবাজিতে কিংবা হ্যান্ড-মাইকে বা হাত-তালি বাজিয়ে সংস্কার নামক মহামূল্যবান শব্দটির আওয়াজ চলে যাচ্ছে দূর বহু দূর। এই আওয়াজ আমার মতো হাতুড়ে লেখকের কানে লাগা তেমন কোনও অসাধ্য বিষয় নয়।

এই সংস্কারের নানান দিকে নানান বিষয়ে শুনতে শুনতে অন্য সকল সংস্কার আশাবাদ ব্যক্ত করা লোকের মতো আমার একটা আশাবাদী উপলব্ধি আসে, আমিও যদি কিছু আশা করতে পারি, তাতে মন্দ কী! যেহেতু আমার বর্তমান কর্মঘণ্টার প্রায় ৮০ ভাগই ব্যয় করছি রাজস্ব খাতের ওকালতি করে, সেহেতু আমার আশাবাদ রাজস্বখাতের সংস্কার বিষয়ে হওয়া বাঞ্চনীয় বিধায় দুই চারটি সুপারিশের আশাবাদ ব্যক্ত করলাম। এই আশাবাদ একেবারে উচ্চস্তরে পৌঁছে রাজস্ব খাতের আমূল পরিবর্তন করা হয়ে যাবে-তা ভাবাটা হবে আমার নেহাত বোকামী। তবে আমার মনের কথাটি যদি পাঠকের মনের কথার কিছু আভাস উঠে আসে আমার সাথে সাথে পাঠকগণ কিছুটা তুষ্টির সুযোগ হয়তবা পাবেন।

রাজস্ব খাতের বড় বড় কর্তা, জ্ঞানী পন্ডিত, বিশ্লেষক ও মহাজন আছেন ও ছিলেন। তাঁদের শ্রম ও মেধার অবদানে আজ রাজস্ব খাত এই পর্যন্ত আসতে পেরেছে এটা অসত্য নয়। আমাদের অতীত রাজনীতির সরকারগুলো এই খাতের মানদণ্ড উন্নতির চিন্তা অগ্রাধিকারের তালিকায় না রাখায় রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি রয়ে গেছে গতানুগতিক। এখানে সততা, নিষ্ঠা, মেধার সাথে কোনও অবস্থায় আপোস করা যায় না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই বিষয়গুলো একেবারেই উপেক্ষিত। যার কারণে বারবার নেতিবাচক সংবাদে শিরোনামে হতে হচ্ছে। যার সর্বশেষ পরিণতি সদ্য আলোচিত মতিউর কাণ্ডে সবাই হতভাগ হয়েছে। উচ্চস্তর থেকে ছাগলনাইয়ার (ফেনি জেলার একটি উপজেলার নাম) কর অফিস পর্যন্ত এই মতিউর কাণ্ড বিরাজমান। একজন দুইজন নয়, শত শত!  সংস্কার করলে এমন জায়গা করতে হবে, যাতে মহামূল্যমান ছাগল আর বাজারে না আসে, মতিউরা ও জেলে যেতে না হয়।

সংস্কার শব্দটি যেমন জনদাবি, তেমনি কঠিনও বটে। এইটা এমন নয় যে মাটির ভাঙ্গা কলসি। ভেঙ্গে গেলো, আর অমনি ফেলে দিয়ে আরেকটি কিনে আনলেই সমাধান হয়ে যাবে! বরং সংস্কার এমন যে, ভাঙ্গা কলসিটির জোড়া লাগিয়ে ধীরে ধীরে তা ব্যবহার উযোগী করে তোলা। ব্যবহার অব্যাহত থাকবে। তার মানে দাঁড়ালো এই সংস্কার এক কিংবা দুই মাসের বিষয় নয়। এইটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। একটু একটু করে এই প্রক্রিয়া সতর্কতার সাথে এগিয়ে নিতে হবে।  শুরুটা হয়েছে, এর শেষ পরিণতি পাওয়ার জন্যে সকল মহলের সহযোগিতা যেমন দরকার হবে তেমনি দরকার দেশপ্রেমিক, আত্মমর্যাদাশীল ও দায়িত্ববান একদল মানুষের, যারা এই প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিবেন। সবচেয়ে বেশি দরকার যখন যে সরকার থাকবে, সে সরকার যেন সংস্কারগুলো অব্যাহত রাখে এবং অগ্রাধিকারের তালিকায় এই খাতে নজর রাখেন।

রাজস্ব খাতে সংস্কারের অগ্রাধিকারের বিষয় হতে পারে: 

বাজেট প্রস্তাবনা তৈরি: বাজেটের সাথে রাজস্ব আদায়ের একটা গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। আমাদের পুরো বাজেট প্রক্রিয়ায় এনবিআর প্রায় শতভাগ জড়িত। এর ফলে বাজেট তৈরির মূল্য উদ্দেশ্যে ও রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়ায় একধরনের অস্পষ্টতা রয়েছে। এখানে বাজেট প্রণয়নে সময়োপযোগী গবেষণা যেমন ঘাটতি আছে, তেমনি যৌক্তিক সময় নিয়ে বাজেট প্রস্তাবনা তৈরির অভাব লক্ষ্যণীয়।

এছাড়া স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বাজেট প্রণয়নের একটা বড় ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি দূর করার জন্যে একটি রূপরেখা সংস্কার কমিটি দিতে পারে। বাজেট প্রস্তাবনা তৈরি থেকে চূড়ান্ত পর্যন্ত একটা সময়ও নির্ধারণ থাকা বাঞ্চনীয়।

রাজস্ব সংগ্রহের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন: আমাদের রাজস্ব আয়ের তিনটি ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন-আয়কর, ভ্যাট ও  শুল্ক। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ খাত হলো আয়কর, অন্যদিকে ভ্যাট ও শুল্ক পরোক্ষ খাত। এই তিন খাতের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় হয় না। কারণ আয়কর একটি আলাদা নম্বর, ভ্যাট একটি আলাদা ও শুল্ক আদায়ের আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকায় কোনও ব্যক্তি করদাতা অন্য কোনও খাতের রাজস্ব ফাঁকি দিলে অন্য খাতের দায়িত্ববান কর্মকর্তা তা নজরে আনছেন না। কারণ ধরেই নিয়েছেন যে, সেটা তার দায়িত্বের বাইরে। তাই  এই খাতের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্যে সকল শ্রেণির করদাতার জন্যে একটি ইউনিক নম্বর ও আদায়ের ব্যবস্থাপনার জন্যে সংস্কার কমিটি সুপারিশ করতে পারে। এতে যে করদাতার যে খাতের কর দেওয়ার জন্যে যোগ্য তিনি সেই খাতের বা একাধিক খাতের যোগ্য হলে সেই সেই খাতে কর দিবেন। একই টেবিলে বসে মনিটরিং করা সহজ হবে এবং রাজস্ব ফাঁকি হ্রাসকরণে সহজ হবে।

দক্ষ জনবল কাঠামো তৈরি: এনবিআর এর সাথে কাজ করার সুবাদে যতকুটু পর্যন্ত দেখতে পেলাম-এই ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের ব্যাপক অভাব রয়েছে। এই খাতের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় সকল সেক্টরই জড়িত। যেমন রাজস্ব খাতের কর্মকর্তা, কর আইনজীবী, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাসহ প্রায় সেক্টর জড়িত। এখানে এনবিআর এর সরাসরি জনবল কাঠামোতে যেমন দক্ষতার অভাব তেমনি সহায়ক অন্যান্য পেশাজীবী বা সেক্টরে নিয়োজিতদেরও দক্ষতার ঘাটতির কারণে রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই বিশাল জনবল কাঠামোতে সরকার এর পক্ষ থেকে যদি দক্ষ দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করে তাহলে রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক সুফল পাওয়া যাবে। তাই সংস্কার কমিটি রাজস্ব আহরণে এনবিআরসহ অন্যান্য সহায়ক সেক্টকরগুলোকে চিহ্নিত করে একটি দক্ষ জনবল নেকটওয়ার্ক গঠনের সুপারিশ করতে পারে।

উৎসে ভ্যাট আদায় বন্ধ করা: আমাদের দেশে যে নিয়মে ভ্যাট সংগ্রহ করা হচ্ছে, তা অযৌক্তিক এবং এই পদ্ধতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। আইনে কর আদায় কর্মকর্তাদের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, এতে নাগরিকদের হয়রানি করার সুযোগ থাকায় অনেকে ভ্যাট দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। তাছাড়া উৎসে ভ্যাট কর্তন করা ও তা সমন্বয়ের সুযোগ না থাকার কারণে পণ্য বা সেবার মূল্য সংযোজন হিসাবে গড় দেখা দেয় এবং সর্বশেষ বাজার ব্যবস্থাপনার উপর মারাত্বক প্রভাব পড়তে থাকে। যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস করে। এতে সকল নাগরিকগণ সমানভাবে পুষ্টি ও চিকিৎসার সেবায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের মানুষেরা কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সার্বিক আর্থিক বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভ্যাট আইনের একটি সময়োপযোগী গবেষণা দরকার এবং পদ্ধতিতে সংস্কার আনা জরুরি।

আয়কর আইনের সংস্কার ও গবেষণা জরুরি। আয়কর আইনের জরিমানার বিধান ও কর-কর্মকর্তাদের ক্ষমতা হ্রাসকরণ জরুরি। একজন কর-কর্মকর্তা নিজে করদাতার কর-কমবেশি করার সুযোগ বা ক্ষমতা রাজস্ব আহরণের অন্তরায়। বিদ্যমান আয়কর আইন ২০২৩ এর ৭৬ নং ধারার বিধান বাতিল হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যে কর-বৈষম্য রয়েছে তা সংস্কার করা জরুরি। ন্যায্যতার নিরিখে সকল নাগরিকদের করের আওতায় নিয়ে আসা এবং সকল শ্রেণি পেশার সক্ষম করদাতা ও কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা না থাকাটা রাজস্ব প্রবৃদ্ধির অন্তরায় বিধায় এই বৈষম্য দূর করা এখন সময়ের দাবি।

আমাদের দেশে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া ও আমলাদের উপর নির্ভর থাকায় আইনে নাগরিকদের সুরক্ষার সুযোগ খুবই সীমিত। আয়কর আইনের একটা গবেষণা দরকার, কোন শ্রেণির মানুষের জন্য আয়কর প্রযোজ্য এবং কিভাবে আদায় করলে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রবাহ বিদ্যমান থাকবে তার জন্যে অঞ্চল ভিত্তিক একটা গবেষণা দরকার। তাই সংস্কার কমিটির সুপারিশে আয়কর আইনের প্রয়োগ ও প্রাসঙ্গিকতার বিষয়ে একটি গবেষণার সুপারিশ থাকতে পারে।

পরিশেষে যা দরকার: রাজস্বখাতের বিশদ সংস্কারের মধ্যে মৌলিক বিষয়গুলো ইতিমধ্যে নানানভাবে সুপারিশে তুলে ধরা হয়েছে। এই সুপারিশগুলোকে ইতিবাচকভাবে বাস্তবায়নের জন্যে দরকার জাতীয় ঐক্যমত। এই সাথে সরকারের সাথে সাথে রাজনৈতিক দলসমূহ, ব্যবসায়ীমহল, বিভিন্ন পেশাজীবিদের সমন্বয়ে এই সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্যে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে।

সুবিধাভোগী দুষ্টচক্র নানানভাবে এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে গড়িমসি করবে এবং পূর্বের ন্যায় নাগরিক সমাজ তাদের ন্যায্যতা হারাবে, রাজস্ব ঘাটিত দিন দিন বাড়তে থাকবে, দেশের অর্থনৈতিক যে চ্যালেঞ্জগুলো বিদ্যমান আছে ও ভবিষ্যতে আসবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা যেকোনও সরকারের জন্যে কঠিন হয়ে পড়বে।

লেখক: আইনজীবী

republiclawchamber@gmail.com