‘ছাত্রানং অধ্যায়নং তপঃ’

"ছাত্রানং অধ্যায়নং তপঃ"— ছাত্রদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে একটি বহুল প্রচলিত  সংস্কৃত ভাষার শ্লোক; যার অর্থ হচ্ছে ছাত্রের একমাত্র তপস্যা হচ্ছে পড়াশোনা করা। তাহলে কি ছাত্রদের পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু করা নিষেধ? আধুনিক বিশ্বে এক্সট্রা কারিক্যুলাম (অতিরিক্ত পাঠ্যক্রম) মানে পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠ্যসূচিতে নেই অথচ তাদের উৎসাহ আছে এমন অনেক বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া। মূলত যেসব বিষয় ছাত্রদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়তা করে। যেমন- খেলাধুলা, সংগীত, ভাষা শিক্ষা, স্বেচ্ছাশ্রম কিংবা ভ্রমণ।

কিন্তু রাজনীতি? ছাত্ররা কি রাজনীতি করতে পারে? ইদানীং এসব প্রশ্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে একজন ছাত্রের রাজনৈতিক দর্শন গড়ে ওঠে। সেই ছাত্র যখন সাবালকত্ব অর্জন করে অর্থাৎ বয়স যখন ১৮ কিংবা কাছাকাছি, তখনই  রাজনীতিতে তার নিজস্ব ধারণার জন্ম নেয় এবং সমাজ নিয়ে নিজের মতো ভাবতে শেখে। ধীরে ধীরে আদর্শিক ডালপালা গজায়, তখনই তার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক একটি গণ্ডির ভেতর রাজনৈতিক চর্চা শুরু হয়। সাধারণত ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো এতে প্রাধান্য পায়, পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সমস্যা উপলব্ধি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অনেকটা ট্রেড ইউনিয়নের মতো। কখনও কখনও জাতীয় সমস্যাগুলো তাদের পীড়া দেয় এবং সেসব সমস্যা সমাধানে, কিংবা অধিকারের প্রশ্নে রাজপথে নেমে আসে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এর উদাহরণ মেলে।

তবে আমাদের উপমহাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস অনেক গৌরবের। প্রতিটি সফল আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্রদের সাথে মাঠে নেমেছিল সাধারণ মানুষ। তবে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রাম শেষে ছাত্ররা আবার ফিরে গেছে তার শ্রেণিকক্ষে, তার পড়ার টেবিলে।

উন্নত বিশ্বে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তারা জাতীয় রাজনীতিতে নীতিনির্ধারণী প্রকল্পে কিংবা গবেষণায় অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে রাজনীতিতে হাতেখড়ি দেয়।

কিন্তু পৃথিবীর কোথাও ছাত্রছাত্রীদের মূল বিষয় পড়াশোনার ব্যাঘাত করে শুধু রাজনীতি করার উৎসাহ প্রদান করে না। এর মূল কারণ হলো, রাজনীতি কোনও পেশা নয়, রাজনীতি হলো মতাদর্শ বা আইডিওলজি যার ভিত্তিতে দেশ এবং সমাজের নেতৃত্ব দেয়। একজন মানুষের আইডিওলজি কখনও পেশা হতে পারে না। একমাত্র শিক্ষা ও দক্ষতা একজন মানুষকে পেশাভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের সহায়তা করে।  আর সেই জ্ঞান মানুষকে তার মতাদর্শের ভিত্তিকে মজবুত করে এবং দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

যে কারণে শুধু ছাত্রদের নিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক দল পৃথিবীর কোথায়ও দেখা যায় না। কারণ, ছাত্রত্ব এমন একটি জীবন, যেখানে একজন মানুষ পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে তার সমাজ এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। আর এই প্রস্তুতির সময়ে যেকোনও ব্যাঘাত দেশ, জাতি কিংবা সমাজের আশা করে না।

বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই সময়ে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ছিল জার্মানি এবং যুক্তরাজ্য। অথচ এই ভয়াবহ যুদ্ধের মাঝেও তারা তাদের বেশিরভাগ স্কুল খোলা রেখেছিল। কারণ তারা জানে, শিক্ষা বন্ধ করা যায় না, দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে শিক্ষা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই। একদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে, প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত ১৬/১৭টি ধাপে জাতি ১৬ থেকে ১৭ দিন পিছিয়ে পড়ে। যে কারণেই কোনও অবস্থাতেই আজও পশ্চিমারা স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখতে রাজি নয়।  সারা বিশ্বে শিক্ষা সফর শেষ করেই তরুণরা রাজনীতিতে আসে। দলকে সমৃদ্ধ করে, দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলে। তরুণ নেতৃত্বেই  তৈরি হয় পুরনো দলের নতুন রূপ কিংবা নব আদর্শের নতুন দল।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রম হলো ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী এক সংকটের সময়, যা জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। ছাত্ররা এখন সরকার পরিচালনা করছে আন্দোলনের অংশীদার হিসাবে। ফলে তারা জড়িয়ে পড়ছে সমাজের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অপকর্মের সাথে। তারা আজ রাজনৈতিক দল গঠন করলো। ধারণা করা হচ্ছে- নির্বাচন করবে, এমনকি জনসমর্থন পেলে সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করবে। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে—আসলে তারা কি ছাত্র? নাকি কিছু তরুণ ‘ছাত্র’ শব্দটি ব্যবহার করছে? যদি ছাত্র হয়, তাহলে পড়াশোনা করবে কে? মেধাভিত্তিক যে সমাজের কথা বলা হচ্ছে, সেই সমাজের নেতৃত্ব দেবে কে? আর এই রাজনীতির কারণে যদি একটি মেধাহীন প্রজন্ম গড়ে উঠে, তার দায় নেবে কে?

লেখক: নির্মাতা ও ব্রডকাস্টার