ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সামনের জাতীয় নির্বাচন যে সময়েই হোক, এটি বিগত নির্বাচনগুলোর মতো হবে না।
নির্বাচনের প্রচারণা, প্রার্থী ও ভোটারদের ব্যবহার এবং সর্বোপরি যেভাবে প্রথাগত নির্বাচন হয়ে থাকে, সেগুলো ভিন্ন হবে।
অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, প্রযুক্তি, জনমিতি, প্রভাব বিস্তারকারী (ইনফ্লুয়েন্সার) ও ভারত বিরোধিতা এবারের জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। যেসব রাজনৈতিক দল এই উপাদানগুলোকে যত সুষ্ঠু এবং দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারবে, তারাই নির্বাচনে তত ভালো করবে এবং বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাবে।
বাংলাদেশ এখন আগের যেকোনও সময়ের থেকে অনেক বেশি পরিবর্তিত হয়েছে। জনগণের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি বেড়েছে তাদের অনুধাবনের ব্যাপ্তি। প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে আগের যেকোনও সময়ের থেকে জনগণ এখন বেশি সচেতন। বাংলাদেশের জনমিতি সামনের নির্বাচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৩৫-এর নিচে এবং ওপরে যাদের বয়স, তাদের চিন্তাভাবনায় অনেক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যটা অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেশি বেড়েছে। সামাজিক গণমাধ্যমে প্রভাব বিস্তারকারীরা (ইনফ্লুয়েন্সার) বিভিন্নভাবে ভোটে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, কারণ তাদের রয়েছে লাখ লাখ অনুসরণকারী। এই অনুসরণকারীদের একটি অংশ যদি প্রভাবিত হয়, তবে নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব রাখতে পারে। ভারত বিরোধিতা এবারে নির্বাচনে বড় আকারে আসতে পারে। জনগণ যদি ভারত-বিরোধিতাকে পছন্দ করে, তবে এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে পারে রাজনৈতিক শক্তিগুলো।
এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন হবে বলে ধারণা করা যায়। এই বিষয়গুলো নির্বাচনকালীন সময়, এর আগে ও পরেও গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হবে। জাতীয় নির্বাচন একটি দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব একটি রাজনৈতিক শক্তিকে (একক বা জোটগতভাবে) নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য দেওয়া হয়।
প্রথাগত নির্বাচন
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। মোটামুটিভাবে নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ধরনের জনসভা, ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে দেখা করা, পোস্টার বা ফেস্টুন দিয়ে প্রচারণা চালানোসহ ইত্যাদি কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। ভোটাররা সাধারণত বড় দলগুলোর যেকোনও একটিকে সমর্থন দিয়ে থাকে এবং পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে বিভিন্নভাবে পৌঁছানোর চেষ্টা করে এবং অনেক ক্ষেত্রে অর্থ বা অন্য সুবিধার বিনিময়ে ভোট পাওয়ার চেষ্টা করে।
১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত (১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি নির্বাচন বাদে) জাতীয় নির্বাচন মোটামুটি অবাধ, সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে। ওই নির্বাচনগুলোতে প্রথাগতভাবে রাজনৈতিক দলগুলো মেনিফেস্টো ঘোষণা, জনসভা, পথসভা, পোস্টার-ফেস্টুন প্রচারণা চালাতো। এছাড়া নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আর্থিক বা অন্য সুবিধার মাধ্যমে ভোট কেনাবেচাও হয়েছে।
২০০৮-এর নির্বাচনের পরের তিনটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এবং সেই অর্থে ওইসব নির্বাচনে জনগণের মতের প্রতিফলন না থাকার কারণে প্রথাগত নির্বাচন থেকে প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিচিত হয়নি।
অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে পৃথিবীর প্রথম ৪০টি দেশের মধ্যে রয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম। মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় তিন হাজার মার্কিন ডলার এবং জীবনমানের অনেক উন্নতি হয়েছে। চরম দারিদ্র্যের পাশাপাশি দরিদ্রের হার অনেক কমেছে। শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়া এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের পদচারণা এখন অনেক বেশি। ফলে সংসারে চাহিদা বাড়ছে এবং জীবনমানের উন্নতি করার জন্য একটি প্রচেষ্টা রয়েছে জনগণের মধ্যে।
সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি সমগ্র জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রতিটি গ্রুপের চাওয়া-পাওয়া বিভিন্ন ধরনের। এই প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি অন্য আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যায়। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী ২০ থেকে ৩৪ বয়সী মানুষ মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮ কোটি জনসংখ্যা ধরে নিলে চার কোটি পঞ্চাশ লাখ। এই গ্রুপটি পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে বা পড়াশোনা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে ঢোকার চেষ্টা করছে অথবা কর্মক্ষেত্রে রয়েছে। তাদের আকাঙ্ক্ষা থাকবে আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ বা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রণোদনা।
যেসব রাজনৈতিক দল এই গ্রুপের ভোট আকর্ষণ করার চেষ্টা করবে, তাদের সতর্কতার সঙ্গে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এখানে লক্ষণীয় যে রাজনৈতিক দলগুলো যেকোনোভাবে একটি পরিকল্পনা তৈরি করে সেটিকে ঘোষণা করলে, সেটি ভালো ফল নাও দিতে পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটি পরিষ্কার যে নতুন প্রজন্ম বা ইয়ং টার্করা প্রশ্ন করে। এটি নিশ্চিত যেকোনও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সেটি নিয়ে তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রশ্ন করবে।
জনমিতি
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০ থেকে ৩৪ বয়সী জনগণ মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ এবং মোট ভোটারের ৩৫ শতাংশ। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এ নির্বাচন একপেশে ছিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি এবং জনগণ তাদের ইচ্ছামতো ভোট দিতে পারেনি। ফলে প্রকৃতপক্ষে এই তরুণ গ্রুপটি প্রথমবারের মতো ভোট দেবে।
গত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময়ে এই তরুণ প্রজন্ম সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং তাদের অনুধাবন ও পরিপক্বতা দেশে মনে হয় ওই গ্রুপটি শুধু আওয়ামী লীগকে নয়, বরং একটি নোংরা রাজনৈতিক সাংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই হিসাবে বলা যায় এই অনুধাবন আগামী নির্বাচনে বিএনপি বা অন্য যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের যে অপসংস্কৃতি ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে গত কয়েক দশক ধরে, সেটির অব্যাহত থাকলে বা এ ধরনের আশঙ্কা থাকলে, এই গ্রুপটি সেটি পছন্দ করবে না।
এটি মোটামুটি নিশ্চিত আগামী নির্বাচনে এই গ্রুপকে কাছে টানার জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দল বিশেষ পরিকল্পনা নেবে।
প্রযুক্তি
ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ওয়েবসাইট ডাটারিপোর্টাল অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এর মধ্যে ২০২৪-এর প্রথম দিকে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল পাঁচ কোটির ওপর। ইউটিউব ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি, ইনস্টাগ্রাম প্রায় এক কোটি এবং টিকটক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এদের মধ্যে অল্প কিছু সংখ্যককে বাদ দিলে প্রায় সবাই ভোটার।
বিশ্বের প্রতিটি দেশে নির্বাচনে বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহার এখন অনেক বেশি। ২০১৬ সালে প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছিল বলে অভিযোগ আছে। আবার ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে থাকে রাজনৈতিক দলগুলো ও প্রার্থীরা। প্রকৃতপক্ষে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভোটারদের কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, সেটি নিয়ে গবেষণা ও বাস্তবায়নের জন্য এখন অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে।
এটি নিশ্চিত যে আগামী নির্বাচনে নিজেদের প্রচারণা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার অনেকাংশে বাড়বে। এর মধ্যে সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারিত ছোট ছোট রিল, ভিডিও বার্তা, তথ্যনির্ভর খবর বা ভিন্ন উপাদান থাকবে। যে রাজনৈতিক দল প্রযুক্তিকে যত বেশি বশ করতে পারবে, সে নির্বাচনের সময়ে ততবেশি ভোটারকে কাছে টানতে পারবে।
প্রভাব বিস্তারকারী
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ধর্মীয় বক্তৃতার ক্যাসেট আগে লাখ লাখ বিক্রি হতো এবং জনপ্রিয় ছিল। বর্তমানে ইন্টারনেটের বদৌলতে এই ধরনের প্রভাব বিস্তারকারীদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এখন শুধু ধর্মীয় বৃক্ততা নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যারা বক্তব্য দেন, যেমন পিনাকী ভট্টাচার্য বা ইলিয়াস হোসেন, তাদেরও অনেক অনুসরণকারী রয়েছে।
আগামী নির্বাচনে এই প্রভাব বিস্তারকারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রচারণা এবং অন্য দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারণা চালানোর জন্য তাদের দ্বারস্থ হতে পারে। তবে এখানে লক্ষণীয় যে এই প্রভাব বিস্তারকারীরা সবাই একসুরে কথা বলে না। ফলে একজন প্রভাব বিস্তারকারী যা বলছেন, হয়তো আরেকজন প্রভাব বিস্তারকারী তার বিপরীত কথা বলছেন।
ভারত-বিরোধিতা
আওয়ামী লীগ শাসনামলে ভারতের সঙ্গে অধিক সখ্যকে বাংলাদেশের জনগণ সন্দেহের চোখে দেখেছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দিল্লি পালিয়ে যাওয়ার পরে ভারতের প্রতিক্রিয়ায় তাদের এই সন্দেহ আগের থেকে অনেক বেশি। ভারতের ‘দাদাগিরি’ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও উদ্বেগ আছে। ভারতবিরোধী কার্ড রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহারের চেষ্টা করবে। তবে, এক্ষেত্রে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কঠিন হবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখা। বড় দলগুলোর জন্য এটি জরুরি কারণ ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নির্বাচনের সময়ে তাদের ভারতবিরোধী অবস্থান হয়তো একটি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলা ট্রিবিউন