মন্দিরে পাহারা, মাজারে আগুন

‘হিন্দু ভাইয়েরা আপনারা যত খুশি মূর্তি বানান, আমরা পাহারা দেব’। গত ১২ সেপ্টেম্বর হেফাজতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব এবং খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের এই বক্তব্যটি অনেক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।

এদিন বিকেলে বাগেরহাট জেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘হিন্দু ভাইয়েরা আপনারা যত খুশি মূর্তি বানান, আমরা আপনাদের পাহারা দেব। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ নিয়ে কোনো বাবার মূর্তি করতে দেওয়া হবে না। যারা তৈরি করবে তাদের হাত ভেঙে দেওয়া হবে।’ এখানে ‘বাবার মূর্তি’ বলতে তিনি কাকে ইঙ্গিত করেছেন, সেটি পাঠক বুঝতে পারছেন।

এর আগে গত ৩১ আগস্টের খবর, নাটোরের বাগাতিপাড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজায় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে উপজেলার সব মন্দির পাহারা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নাটোর জেলা জামায়াতের আমির মীর নুরুল ইসলাম। এদিন সকালে গালিমপুর সর্বজনীন শ্রী শ্রী দুর্গামন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এই ঘোষণা দেন।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ওপর হামলা ও মন্দিরে ভাঙচুরের খবর আসে। এ সময় অনেক জায়গায় মন্দির পাহারা দেওয়ার উদ্যোগ নেন স্থানীয়রা। বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মাদ্রাসারা শিক্ষার্থীদের মন্দির পাহারা দেয়ার ছবি গণমাধ্যমে আসে।

গত ৯ আগস্ট বাংলা ট্রিবিউনের একটি খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং সে দেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বিশেষ কমিটি গঠন করেছে ভারত সরকার। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শুক্রবার এদিন দুপুরে তার এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) পোস্ট করেছেন: ‘বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নজর রাখতে মোদি সরকার একটি কমিটি তৈরি করেছে। এই কমিটি বাংলাদেশে তাদের কাউন্টার পার্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চ্যানেলগুলো উন্মুক্ত রাখবে, যাতে সেখানে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিক, হিন্দু এবং অন্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায়।’

এর আগের দিন, অর্থাৎ ৮ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তখন তিনিও হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন।

প্রশ্ন হলো, যে দেশের সংবিধানের মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং যেখানে বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে—সেখানে কোনও একটি ধর্মের উপাশনালয় বা তাদের মূর্তি কেন পাহারা দিয়ে রাখতে হবে? কোনও মসজিদ কি পাহারা দিয়ে রাখতে হয়?

যে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলা হয়, সেই দেশের কোনও একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে বিশেষ নিরাপত্তা দিয়ে রাখতে হবে কেন? কেন তারা আক্রান্ত হবেন এবং কেন তাদের নিরাপত্তার জন্য অন্য একটি দেশ কমিটি করবে কিংবা উদ্বেগ জানাবে?

২.

যখন নাশকতাকারীদের প্রতিহত করতে মন্দির পাহারা দেয়ার খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম, একই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙা এবং তাতে আগুন দেওয়ার খবরও এসেছে। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়া অনেক ভিডিওতে দেখা গেছে, ‘তৌহিদী জনতা’ মনের আনন্দে মাজার ভাঙছেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইভেন্ট খুলেও মাজার ভাঙার আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে মন্দির পাহারা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, মাজার ভাঙা এবং সেখানে আগুন দেওয়ার বিষয়ে তাদের অবস্থান কী? কারা মাজারে আগুন দিচ্ছেন? তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী?

এখন পর্যন্ত যেসব মাজার ভাঙা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সিলেটের শাহপরান মাজার, গাজীপুরের শাহ সুফি ফসিহ পাগলার মাজার, নারায়ণগঞ্জের দেওয়ানবাগ ও হজরত হোসেন আলী শাহের মাজার, নোয়াখালীর ফকির চাড়ু মিজি শাহ্ (র.) মাজার, সিরাজগঞ্জের ইসমাইল পাগলা ও আলী পাগলার মাজার, ঠাকুরগাঁওয়ের বিবি সখিনার মাজার, ঢাকার ধামরাইয়ে বাবা বুচাই চান পাগলার মাজার ইত্যাদি। অভিযোগ, এসব মাজারে অসামাজিক কাজ হয়। কেউ কেউ ফেসবুকে লিখেছেন যে মাজারে গাঁজা খাওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, গাঁজা বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য আরও অনেক স্থানেই খাওয়া হয়। সেসব জায়গায় কি হামলা চালানো হয়েছে? বলা হচ্ছে, মাজারে শিরক হয়। গান-বাজনা চলে।

কোনও কোনও মাজারে প্রতারণা, মাদক সেবন ও ইসলামবিরোধী কার্যক্রম চলার অভিযোগ থাকলেও সেইসব মাজারের নিচে যে কোনও ওলি আউলিয়া শায়িত নেই, সেটি কে নিশ্চিত করবে? যদি কোনও পীরের কবরকে কেন্দ্র করে মাজার তৈরি করে সেখানে কোনও অবৈধ কাজ চালানো হয়, সেই দায় কি ওই পীরের? এভাবে মাজার ভাঙা ও আগুন দেওয়ার মধ্য দিয়ে কাকে অসম্মানিত করা হচ্ছে?

তাছাড়া কিছু কিছু মাজার এখন পর্যটনকেন্দ্র। মানুষ সেখানে ঘুরতে যায়। কেউ কেউ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেও যায়। কেউ কেউ মনের আশা পূরণের জন্য মাজারে গিয়ে দোয়া করেন। কেউ যদি মাজারে গিয়ে সেজদা করেন, সেটি ইসলামের মূল চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও সবাই এই কাজ করেন না। সবাই কি মাজারে মাদক সেবনের জন্যও যান না। মাদক সেবনের আরও অনেক জায়গা আছে।

৩.

মাজার ভাঙার প্রতিবাদ জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম গত ৭ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে লিখেছেন: ‘মাজার ও ইসলামের বিভিন্ন তরিকা এবং মাসলকের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা বন্ধ করতে হবে। আজ মাজার ভাঙবে, কাল সত্যপন্থী পীরদের দরগা দরবার ভাঙ্গা হবে, পরশু ভিন্ন তরিকার মসজিদ ভাঙ্গা হবে- এসকল নৈরাজ্য যারা করে বেড়াচ্ছেন, তারা ইসলাম ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের জনগণকে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ইসলামের বৈচিত্র্য রক্ষা করতেই হবে।’

তিনি আরও লিখেছেন: ‘প্রথমে শিয়াদের হত্যা করবেন, তারপর কাদিয়ানী, তারপর পীর ও পীরের মুরিদদের, তারপর গণতন্ত্রপন্থী আলেমদের, তারপর পাবলিক প্লেসে হাজির মুসলিম নারীদের, তারপর কোনোভাবে তাদের ইসলামের বিরুদ্ধে যায় সবাইকে হত্যা করে দেশটা হিন্দুত্ববাদীদের বিচরণ ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলবেন। এ দেশের না ইনারা, উনারা ভিনদেশের এজেন্ট। খুবই স্পষ্ট ইনাদের মিশন।’

তার এই শক্ত স্টেটমেন্টের পরেও মাজার ভাঙা হয়েছে। এরকম বাস্তবতায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার গণমাধ্যম শাখা থেকে পাঠানো একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমাদের নজরে এসেছে যে, গত কয়েকদিন ধরে কিছু দুর্বৃত্ত দেশের সুফি মাজারগুলতে হামলা চালাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা এবং সুফি মাজার সম্পর্কিত যে কোনও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। এ সকল হামলার সাথে জড়িতদের অতি দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘ধর্মীয় উপাসনালয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনাসমূহ রক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দেশ। ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতিকে বিঘ্নিত করার যেকোন প্রচেষ্টা সরকার দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করবে।’

যেদিন এই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে সেদিনও সিলেট শহরতলির খাদিমপাড়া এলাকায় শাহ সুফি আব্দুল কাইউম চিশতিয়ার মাজার ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ফজরের নামাজের পর বহিরাগত কয়েকজন হাতুড়িসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে মাজারটি ভেঙে ফেলে।

প্রশ্ন হলো, যখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় আছেন, যখন পুলিশ অফিসিয়ালি কাজে ফিরেছে, তখন এরকম কোনও দল বা গোষ্ঠীর লোকজন একত্র হয়ে যখন মাজার ভাঙতে গেলো তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বাধা দিলো না কেন? তারা কি আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ছিল নাকি এই ধরনের মব জাস্টিসে তাদের সমর্থন রয়েছে? নাকি তারা এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল?

প্রশ্নটা এ কারণে যে, গত রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ডেইলি স্টারের একটি খবরে বলা হয়েছে, ঢাকার ধামরাইয়ে বুচাই পাগলা ও বরকত মা মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় চার দিন পরও দৃশ্যমান কোনও ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। দায়সারা বক্তব্যেই আটকে আছেন তারা। উপরন্তু মাজার ভাঙচুরকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাদের সঙ্গেই আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, এই মাজারটিতে মূলত নারীরা দল বেঁধে আসতেন। প্রার্থনা করে চলে যেতেন। মাজারটিতে কোনও অনুষ্ঠান হতো না। এমনকি ওরশও হতো না। শুধু কবরটিই বাঁধানো ছিল। মাজার ভাঙচুরে ক্ষোভ প্রকাশ জাহাঙ্গীর আলম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা গণমাধ্যমকে বলেছেন, এলাকার একটি লোকও মাজার ভাঙার সঙ্গে জড়িত না। যারা ভেঙেছেন তারা বহিরাগত।

তবে দেরিতে হলেও যেহেতু প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে মাজার ভাঙার বিরুদ্ধে শক্ত স্টেটমেন্ট এসেছে, ফলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে, এই ধরনের মব জাস্টিক, মাজার ভাঙা এবং বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নারীদের নিগৃহীত করার ঘটনা বন্ধ হবে। সেজন্য অবশ্য আগামী দিনগুলোয় কী কী ঘটে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। সেইসাথে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম এই ধরনের ঘটনার পেছনে যে ‘ভিনদেশের এজেন্ট ও তাদের মিশনকে’ ইঙ্গিত করছেন, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, দিন শেষে দেশটা সবার। এখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে হিন্দুরা অনিরাপদ বোধ করবেন—সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

পরিশেষে, কিছু মাজারে ‘অসামাজিক কাজ’ হয় অভিযোগ তুলে সেখানে আগুন দিয়ে বাংলাদেশকে মৌলবাদী ও উগ্রবাদীদের দেশ বলে প্রমাণ করার ষড়যন্ত্র কেউ চালাচ্ছে কি না—সে বিষয়ে চোখ কান খোলা রাখা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক