ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেকে বলেছেন দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। মানুষ মনে করে বছরের পর বছর ভোটাধিকার হরণের যে ধারাবাহিক সংস্কৃতি, ভিন্ন মতের মানুষের বিচার না পাওয়া বা বিনা বিচারে দীর্ঘকাল আটকে রাখা, গুম, আয়নাঘর, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টারের নামে মানুষ হত্যা, রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিটি রন্ধ্রে দুর্নীতি, উন্নয়নের আড়ালে লুটপাট এবং লুটের অর্থ বিদেশে পাচার, ব্যাংক খেয়ে ফেলা, দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুয়ের কণ্ঠরোধের যে বিষাক্ত সংস্কৃতি শেখ হাসিনা এবং তার সরকার গত দেড় দশকে চালু করে গেছেন সেখান থেকে মানুষ স্বাধীন হয়েছে বলেই একে তারা দ্বিতীয় স্বাধীনতা ভাবছে।
ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘঠিত গণ-অভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়া বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সরকার চেষ্টা করছেন সেই জঞ্জাল সাফ করে দেশকে একটা ন্যায়ভিত্তিক, সত্যনিষ্ঠ বাংলাদেশে রূপান্তর করতে, চাচ্ছেন একচোখা নীতির বদলে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে।
ইতিমধ্যে দেশের নানা দলের, নানা মতের, নানা শ্রেণি পেশার মানুষ নতুন সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে, সরকারের প্রতি মানুষ সমর্থন ও ভালোবাসা জানিয়েছে। এই সরকারকে নিয়ে মানুষের অনেক আশা ও স্বপ্ন।
আশার পাশাপাশি আশাভঙ্গের বেদনাও যে একদম নেই তা নয়। কিন্তু একটা সরকারের এক মাসের মাথায় তার ভুলত্রুটির খতিয়ান নিয়ে বসা কোনও শুভ লক্ষণ নয়। তবে গতকাল জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এবং তার আগেও বিভিন্ন সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন দেশের মানুষ যেন তাকে, তাদের সরকারকে পরামর্শ দেন। সেই সাহসে একটা বিষয়ের অবতারণা করার জন্যই এই লেখার প্রয়াস।
গতকাল বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ৭৬তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। সেখানে আলোচকদের কেউ কেউ বলেছেন, জিন্নাহ না হলে বাংলাদেশ হতো না। এই খবরটা দেখার পরে আমার মতো দেশের অনেক মানুষ হতবাক হয়েছে, নির্বাক হয়েছে।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনিও একাত্তরের একজন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন থেকে শুরু করে তহবিল সংগ্রহ এবং প্রবাসী সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা– সবই আপনি করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। মুক্তিযুদ্ধে আপনার অবদানকে খাটো করার কোনও অবকাশ নেই।
অনেকে বলতে পারেন, ৫ আগস্টের পরে যেহেতু দেশ আবার স্বাধীন হয়েছে তাই এখন যার যা খুশি বলার অধিকার আছে। আসলেই কি তাই? বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান থেকে শুরু করে কোনও আইন আদালতই তো বিলুপ্ত হয়নি। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে যেখানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে; সেখানেও কিছু বিধি-নিষেধ আছে। চাইলেই তো কেউ মিথ্যা বা অসত্য তথ্য প্রচার করতে পারে না।
জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা, শালীনতা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে এমন বাক স্বাধীনতা সংবিধানও আমাদেরকে দেয়নি। আমরা কি আমাদের একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুরোপুরি মুছে ফেলবো, বাদ দিয়ে দেবো?
ইতিমধ্যে জামায়াতের প্রয়াত আমীর গোলাম আযমের পুত্র জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তুলে দেশব্যাপী ব্যাপক হইচই সৃষ্টি করেছেন। শেষ পর্যন্ত বিব্রত জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে ওই বক্তব্য ওনার নিজের এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।
জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকী পালনের ঘটনাটাও সেরকম একটা নেতিবাচক অর্থে দুঃসাহস বা স্পর্ধা দেখানোর মতো ঘটনা। নওয়াব সলিমুল্লাহ একাডেমি বা যারাই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করুক, দোষ হবে অন্তর্বর্তী সরকারের এবং আমাদের সন্তানতুল্য ছেলেমেয়েদের, যাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ দুঃশাসনমুক্ত হয়েছে।
ওই অনুষ্ঠানে নজরুল ইসলাম নামের এক বক্তা বলেন, “যে কোনোভাবেই হোক’ আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমাদের পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ না থাকলে পাকিস্তান সৃষ্টি হতো না, আর পাকিস্তান না থাকলে বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আমাদের জাতির পিতা, কিন্তু সেটা আমরা স্বীকার করি না। তিনি আশা করেন, প্রতিবছর বাংলাদেশে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হবে।
নজরুল ইসলামের মতে, ৭১ সালে আমরা যে কোনও ভাবেই হোক স্বাধীন হইনি। আমাদের স্বাধীনতার একটা দীর্ঘ পথপরিক্রমা আছে, আন্দোলন সংগ্রাম রক্ত এবং প্রাণ বিসর্জনের ইতিহাস আছে। আর সেই ইতিহাসের শুরুই হয়েছে জিন্নাহকে দিয়ে। একটু ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক–
পাকিস্তানের জাতির পিতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার কেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন; “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” যদিও লাহোরে জন্ম নেওয়া জিন্নাহর মাতৃভাষা ছিল গুজরাটি। নিজের মাতৃভাষা গুজরাটি এবং উর্দু- কোনোটিতেই সাবলীল ছিলেন না জিন্নাহ। তিনি বলতে এবং লিখতে পছন্দ করতেন ইংরেজিতে। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণায় সেদিন ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) ছাত্র সমাজ। তারা জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, মিছিল সমাবেশ করেন, অত্যাচারিত হন, কারাবাস করেন। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি- রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ অনেকের তাজা রক্ত আর প্রাণের বিনিময় আমরা পেলাম আমাদের প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষার মর্যাদা।
২১ ফেব্রুয়ারি হলো আমাদের শহীদ দিবস, পরবর্তীকালে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়ে যা বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
ইতিহাসবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৪৮ এ জিন্নাহর সেই ঘোষণার মধ্যে দিয়ে। সেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ৫২ সালে এসে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ প্রথম স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শুরু করে, স্বাধীনতার জন্য সংগঠিত হতে শুরু করে।
সেই ধারাবাহিকতায় ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি, ৬২ সালের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের দাবিতে শেখ মুজিবের ৬ দফা ঘোষণা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার ঘোষণা, ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাক বাহিনীর বর্বর গণহত্যা এবং তারপর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা। (তথ্যসূত্র: স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র) ২৫ মার্চ থেকে পরবর্তী ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকসেনা এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আল বদর বাহিনীর হিংস্রতা ও বর্বরতার ইতিহাস আজ কারও অজানা নয়।
সেই ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে কিনা পালিত হলো পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকী, তাও আবার জাতীয় প্রেসক্লাবে! যেই প্রেসক্লাব ভবনও একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্যদের গোলার আঘাত থেকে রক্ষা পায়নি। মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন সিরাজুদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, সেলিনা পারভীন, শহীদ সাবের, আ ন ম গোলাম মোস্তফাসহ অনেক প্রতিথযশা সাংবাদিক।
মুক্তবাকের সুযোগে আরেকটা কথাও বলতে চাই। পাকিস্তানের জাতির পিতার মৃত্যুদিনে কাল ঢাকায় নির্বিঘ্ন অনুষ্ঠান হয়ে গেলো আর গত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যার দিনটিতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের পুড়িয়ে দেওয়া ভবনের সামনে ফুল দিতে যাওয়া লোকদেরকেও নানা রকম হেনস্তা, আক্রমণ ও অসম্মানের শিকার হতে হয়েছে। সেখানে লুঙ্গি ডান্স নামে বিজাতীয় সংস্কৃতির হিন্দি গানের সাথে তাণ্ডবনৃত্য চলেছে রাতভর। এই ঘটনাও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান এবং রক্তদানের আদর্শের সাথে বেমানান।
স্বৈরশাসক হিসেবে শেখ হাসিনার অপরাধ তার পিতার ওপরে বর্তায় না। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বিদায় হজের ভাষণে পিতার অপরাধে পুত্রকে বা পুত্রের অপরাধে পিতাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না বলে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
আসল কথা হলো, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ একটা কঠিন সংকটকাল পার করছে। এখন বিভক্তি নয়, দেশকে সংহত করার সময়। ড. ইউনূসের সরকার সেজন্য দেশবাসীর সহায়তা চাচ্ছেন, তিনি পুরো দেশকে একটা পরিবার করার চেষ্টা করছেন। এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানের পরাজিত প্রেতাত্মা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা সেই এক পরিবারের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের পথের অন্তরায়। যারাই এসব আয়োজন করছেন এবং এরকম আরও আয়োজনের পরিকল্পনা করছেন, তারা বর্তমান সরকার, বাংলাদেশ বা দেশের বৈষম্যবিরোধী আপামর মানুষের বন্ধু নয়, বরং সুযোগসন্ধানী বলেই মনে হয়। এদের ব্যাপারে সরকার, প্রশাসন, ছাত্র সমাজ, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের সচেতন হবার এখনই সময়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী