চিকিৎসা সেবায় জনগণের আস্থা বাড়াতে হবে

স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা আমাদেরকে ব্যাথিত করে। এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ফলে সাধারণ মানুষ আমাদের দেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসা সেবার প্রতি ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছে। অথচ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চিকিৎসা খাতে সাধারণ মানুষের আস্থার মাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘটেছে এর উল্টো।

ভুল চিকিৎসা,  ভুয়া চিকিৎসক, রোগীর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ না দেওয়া, সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া, রোগীর কাছ থেকে অনৈতিক অর্থ আদায়, বেসরকারি হাসপাতালে খরচের বাড়াবাড়ি, নকল ওষুধ- এমন অনেক অভিযোগের বিষয়ে প্রায়ই সংবাদ প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে আসে তাতে যে কেউই চমকে উঠবে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিকট অসংখ্য অভিযোগ জমা হলেও বাস্তবে সেগুলো যথাযথভাবে নিস্পত্তি হয় না। অবশ্য বিএমডিসির ব্যাখ্যা, ভুক্তভোগীর ব্যাখ্যা এবং বাস্তবতা মিলিয়ে বিষয়টি গভীর অনুধাবনের প্রয়োজন রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই চিকিৎসার জন্য পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করলে সিরিয়াল পেতেই হিমশিম খেতে হয়। কারণ আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। অথচ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসক এবং হাসপাতাল রয়েছে। তাহলে বাংলাদেশের চিকিৎসার প্রতি আস্থা না রেখে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পেছনের যুক্তিটি কী?

এই প্রশ্নের উত্তরে এক কথায় বলা যায় যে আমাদের দেশের চিকিৎসার প্রতি মানুষের আস্থার সংকট, আর ভারতের চিকিৎসায় আস্থা সৃষ্টি। আন্তর্জাতিক মানের ভালো চিকিৎসক থাকলেও নানাবিধ কারণে রোগীরা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আর এই আস্থা হারানোর পেছনের কারণ হিসেবে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

মূলত একশ্রেণির ডাক্তার অনৈতিক মুনাফাবাজি, বাণিজ্যিক ও অপেশাদার মনোভাবের কারণে দেশের পুরো স্বাস্থ্যখাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার সুযোগ বৃদ্ধি পেলেও কিছু নৈতিকতাহীন চিকিৎসকের নেতিবাচক ভূমিকায় সাধারণদের আস্থার সংকট প্রকট হচ্ছে। অনেক সময় আমরা শুনে থাকি বড় বড় সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি হতেও নাকি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়।

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো চিকিৎসা। কিন্তু এই মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এমনকি চিকিৎসকদেরকেও হয়রানি করা হয়। অনেক মানবিক চিকিৎসক হয়রানির শিকারও হন। যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে কিছু অনৈতিক চিকিৎসকের কারণে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্থ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবার বাণিজ্যকীকরণ নিয়েও অনেক তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জানতে পারি। এর বিপরীতে চিকিৎসা সেবার বাণিজ্যিকীকরণের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী দেখা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা, রোগ নির্ণয় বা ডায়াগনোসিস, ব্লাডব্যাংক এবং সিসিইউ, আইসিইউ’র নামে চলছে অনৈতিক বাণিজ্য।

হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও অনৈতিক কাজ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি ও টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও অবস্থার তেমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে। একদিকে বড় বড় সরকারি হাসপাতালের পেছনে সরকার বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছে, অন্যদিকে রোগ নির্ণয় এবং সার্জিক্যাল অপারেশনের জন্য নামসর্বস্ব, মানহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দালালরা সরল সাধারণ রোগীদের সেখানে যেতে বাধ্য করছে। মোটা অংকের মাসোহারা বা কমিশন বাণিজ্যের লোভে একশ্রেণির চিকিৎসকও এই চক্রের সাথে জড়িত আছেন বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে টিআইবি’র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিতে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তাদের ১০ হাজার টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। রোগীদের রোগ নির্ণয়ে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার ও দালালদের কমিশন ভাগাভাগির তথ্যও উঠে এসেছে টিআইবি’র প্রতিবেদনে।

স্বাস্থ্যসবা খাতের মতো একটি জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের প্রতিটি স্তরে এমন দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা পুরো জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। চিকিৎসকদের মানুষ সেবাদানকারী হিসেবে দেখতে চায়, চিকিৎসা কোনও বাণিজ্য নয়, এটি একটি সেবাদান প্রক্রিয়া। চিকিৎসার সাথে বাণিজ্য শব্দটি মানানসই না। কাজেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিয়োজিত প্রতিটি চিকিৎসকককে নিজস্ব সচেতনতা এবং দায়িত্ববোধ থেকে সেবা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া উচিত।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 sultanmahmud.rana@gmail.com