অপমান নিয়ে বিদায় নিলেন শেখ হাসিনার দুই প্রধান বিচারপতি

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য যে তার সরকারের নিয়োগকৃত দুই জন প্রধান বিচারপতিকে বিদায় নিতে হলো লজ্জাজনকভাবে। একজনকে বিদায় দিয়েছিলেন তিনি স্বয়ং, অন্যজন ১০ আগস্ট ছাত্র-জনতার দাবি মুখে পদত্যাগ করেছেন।

ফেসবুক মেমোরি দেখাচ্ছে যে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল সাত বছর আগে ২০১৭ সালের এই সময়ে। সিনহার সিভি দেখলে যে কেউ বলবেন, তার যোগ্যতা 'বটতলার উকিল'-এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু শেখ হাসিনা তাকে প্রধান বিচারপতি করেছেন যোগ্য লোকদের ডিঙিয়ে। তার একটা কারণ ছিল, সিনহা অনুগত থাকবেন এবং তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের। হিন্দু বলেই ভাবতে পারেননি যে সিনহা ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটিতে থাকতে পারেন।

কিন্তু অযোগ্য লোক কর্তৃত্ব দেখাতে গেলে যা হয়, সরকারের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব লেগে যায় নানান ইস্যুতে। হাইকোর্টের সামনে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য স্থাপন, ফাঁসির আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তিনি বিতর্কিত হন সহকর্মীদের কাছেও।

তার সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত রূপ নেয়, সংসদ নাকি বিচার বিভাগ—কার কর্তৃত্ব বেশি এই বিষয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে।

সিনহার বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ ছিল, সিনহার ষোড়শ সংশোধনীর রায়টা একটা ষড়যন্ত্র। কারণ তিনি রায়ে যে অবজারভেশন দিয়েছেন, সুস্থ মস্তিষ্কে অবজারভেশনগুলো পড়লে মনে হবে যে এই প্রজাতন্ত্রটি অকার্যকর হয়ে গেছে। ষড়যন্ত্র না হলে তিনি এমন নির্মম হতে গেলেন কেন?

এই নিয়ে কয়েকটি কলাম লিখেছিলাম। ফেসবুক মেমোরি দেখাচ্ছে, ২০১৭ সালে এই দিনে আমি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম, [গোঁজামিল প্রতিষ্ঠিত করতে লম্বা বয়ান দিতে হয়। ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ের বয়ানে ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন সবই আছে—নেই শুধু উনাদের বিচার করার মতো ব্যক্তির অনুসন্ধান।

আদিম সমাজেও কখনও মানুষ নিজের বিচার নিজে করেনি। জজ সাহেবদের অভিলাষ উনারা তাই করবেন। করেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে দেখলাম, দুনিয়াতে সবাই খারাপ, তারাই শুধু ঠাকুর।

আপনারাই তো নিরপরাধ যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা, সক্রেটিসকে বিষপানে মৃত্যু, গ্যালিলিওকে ফাঁসি, জোয়ান অব আর্ককে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই না?

আদালতের অনাচারও দুনিয়ার মানুষ কম দেখেনি! ]

সিনহা শেষ পর্যন্ত টিকেনি।‌ রানা দাশগুপ্তের সহায়তায় তিনি হিন্দু কার্ড খেলতে গিয়ে ভারতের মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সত্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বিদেশে চলে যেতে হয়। নিজের দুর্নীতির জন্য সহকর্মীদেরও কোনও সহানুভূতি পাননি।

দুর্ভাগ্য যে সরকারের বিরোধিতা করতে করতে অন্ধ হয়ে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত সিনহার অপসারণের বিরোধিতা করেছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিয়ে সিনহা ছিলেন জামায়াত-বিএনপির চক্ষুশূল। কিন্তু ১৬তম সংবিধান সংশোধনীর রায় নিয়ে সরকারের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বে সিনহাকে তারা পেলেন বীরপুরুষ হিসেবে, যদিও সে রায়ের অবজারভেশনে জিয়াউর রহমানকে বলা হয়েছে অবৈধ, বিএনপি অবৈধ সন্তান।

২.

গত বছর শেখ হাসিনার সরকার প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে। বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বলে ২০০৬ সালে প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে বর্জন করে আওয়ামী লীগ লগি বৈঠা আন্দোলন করলো, অথচ ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করলেন না শুধু, দলীয় আনুগত্য না থাকলে প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত করেননি কাউকে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আল্টিমেটামের মুখে ১০ আগস্ট পদত্যাগ করেছেন তার সরকারের নিয়োগকৃত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ওইদিন সকালে ফুলকোর্ট সভা ডেকেছিলেন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রবল প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সভা বাতিল করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক তারিকুল ইসলাম মিডিয়াকে বলেছেন, তাদের কাছে তথ্য ছিল যে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘সাংবিধানিকভাবে অবৈধ ঘোষণা' করতেই ফুলকোর্ট সভা আহ্বান করা হয়েছিল।

বিদায়ী বিচারপতি রায় প্রদানের ক্ষেত্রে কতটা নিরপেক্ষ ছিলেন সেটা আমি জানি না। কিন্তু বিচারপতি হিসেবে তার এবং বিচারপতি মানিকের অপেশাদার আচরণ ইতিহাসে লেখা থাকবে। মানিকের কথা নতুন করে কী বলবো? সবাই জানেন কীভাবে তিনি কথা বলেন, বিচারপতি থাকাকালে হিসাব না করে সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন, এমনকি চাকরিরত অবস্থায় তিনি টিভি টকশোতে অংশ নেন। আর সেসব অনুষ্ঠানে যে ভাষায় কথা বলেন তা তো এখন ভাইরাল হয়ে গেছে।

অন্যদিকে ওবায়দুল হাসান প্রধান বিচারপতি হয়েও ভুলতে পারিনি তিনি একজন ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। তার বাড়ি ময়মনসিংহের নেত্রকোনায়। আমি আশ্চর্য হয়েছি এই তুমুল আন্দোলনের মধ্যে তিনি ময়মনসিংহ নেত্রকোনাবাসীর সংবর্ধনা নিচ্ছেন। আন্দোলনরত ছাত্রদের জন্য সময় বের করতে পারছেন না, ছাত্ররা যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে তাকে গুরুত্ব দিয়ে শুনানির জন্য এগিয়ে না এনে রাজনৈতিক নেতাদের মতো তাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়েছেন।

আপনারা হয়তো ভাববেন উনি চলে যাওয়ার পর সাহসী হয়ে আমি এসব কথা বলছি। না। রাষ্ট্রের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার প্রতি আমার সম্মান রয়েছে এবং সেই সম্মান বজায় রেখেই তিনি দায়িত্ব পালনকালে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে লিখেছিলাম,

[ব্রিটিশ আমলে চলমান কোনও বিষয়ে পক্ষপাতী হয়ে যেতে পারেন সে কারণে নাকি বিচারকদের স্থানীয় পত্রিকা পড়া নিষিদ্ধ ছিল।

বিচারকদের ক্লাবে যাওয়া তো নিষিদ্ধ ছিলই, কোনও সামাজিক সমাবেশে যাওয়ারও অনুমতি ছিল না, এমনকি বিয়ে বাড়িতে।

এখন মাশাআল্লাহ বিচারকরা নগরীর সেরা ও বুনিয়াদি ক্লাবে যান, যেখানে মদ বিক্রি হয়। আর দশ জন সদস্যের মতো সময় কাটান। ওনাদের আড্ডার টেবিলে নগরীর সেরা দেশি এবং বিলাতি ডিগ্রির উকিলরা তো থাকেনই, কোনও মক্কেল পাওয়াও বিচিত্র নয়। আমি তো এমনও পেয়েছি সাংবাদিকের বাড়িতে মদের আড্ডায় সর্বোচ্চ আদালতের কর্মরত এক বিচারক মদ খাচ্ছেন।

এবার তো নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। বিচারপতি মহোদয় পদোন্নতি পেয়ে শুভেচ্ছা গ্রহণ করছেন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছ থেকে। এলাকার লোকদের দেওয়া নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দিচ্ছেন, ধর্মীয় বিতর্কিত সংগঠনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হচ্ছেন।

দুনিয়া বদলে যাচ্ছে... বদলে যাচ্ছে সব রীতি রেওয়াজ। প্রার্থনা এই যে দেশে এবং দুনিয়ায় বিচারকার্য যাতে শেষ পর্যন্ত থাকে।]

৩.

আমি নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। অভিনন্দন জানাচ্ছি বর্তমান আইন ও সংসদ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকেও– একজন গ্রহণযোগ্য বিচারপতিকে এই আসনে বসতে সহায়তা করার জন্য। তার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে দলীয় আনুগত্যের চেয়ে স্বাধীন যোগ্য এবং মেরুদণ্ডসম্পন্ন ব্যক্তিদের দিয়ে তিনি যাতে কলুষিত এই বিচার বিভাগকে নতুন করে সাজান এবং বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা তৈরি করেন।

সেই সঙ্গে অনুরোধ করবো অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইন–দুটির অযৌক্তিক, কালো ধারাগুলো বাদ দিয়ে সর্বজনীন করেন।

লেখক: সাংবাদিক

anisalamgir@gmail.com