প্রাচীন জমিদারি প্রথা থেকে শুরু করে অদ্যাবধি করদাতাদের অসন্তোষ কমানোর উদ্যোগের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। সভ্যতার ক্রম বিকাশ ও জমিদার প্রথার নানান ধাপে নেতিবাচক দিকগুলোর দিন শেষ হয়েছিল ১৯৫০ সালে। “স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট-১৯৫০”-এর মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বাতিল হয়েছিল এবং তা কার্যকর হয় ১৯৫১ সালের ১৬ মে থেকে। এই জমিদারি প্রথায় জমিদাররা মূলত কোনও ভূমির মালিকানায় ছিলেন না। ভূমির প্রকৃত মালিক ছিল রায়াত বা কৃষক। জমিদাররা ছিলেন তৎকালীন সরকারের খাজনা বা ট্যাক্স আদায়ের এজেন্ট। এই ট্যাক্স এজেন্ট বা জমিদাররা ইচ্ছামতো কৃষকদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করতো এবং অনাদায়ী ট্যাক্স পরিশোধের জন্য নানাভাবে অত্যাচার নিপীড়ন চালাতো। এই জমিদাররা এতটাই ক্ষমতাধর ছিলেন যে তাদের ভয়ে প্রজারা তটস্থ থাকতো, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ দেওয়ার সাহস ছিল না। এমনও উদাহরণ আছে, এই জমিদারদের রোষানলে পড়ে অনেক সাধারণ প্রজা সর্বস্ব হারিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। নবাব সিরাউদ্দৌলার পতনের পর ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নীতির (১৭৯৩) মাধ্যমে জমিদাররা সুকৌশলে কৃষকদের ভূমির মালিকানা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজেরা ভূমির মালিকানা অর্জন করতে থাকেন।
জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হয়েছে বহু আগে। এখন এই প্রথার নাম গন্ধ থাকার কথা না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সময় অনেক পার হলেও সেই জমিদারদের বংশধর যুগ থেকে যুগান্তরে নানা কৌশলে টিকে আছে দেশে দেশে, সমাজে তথায় প্রযুক্তির যুগের রাষ্ট্রেও। কারণ তারা প্রজাদের শোষণ করতে একটা আলাদা মজা পান। আমাদের রাষ্ট্রে দুই একজন মতিউর শুধু না, হাজার হাজার মতিউরকে পাবেন, যারা নানা কৌশলে তাদের পূর্ব পুরুষ জমিদারকে অনুসরণ করছেন এবং অঢেল সম্পত্তি গড়ে তুলছেন। দুই একটা ঘটনা সামনে এলে অনেকে হায় হায় করছেন! কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের শাসক শ্রেণি ব্রিটিশ রাজাদের মতোই তাদের ভোগবিলাসের চিন্তায় মগ্ন থাকেন, প্রজাদের চিরজীবন শোষিত রাখতে পছন্দ করেন। আর মতিউরের মতো নব্য জমিদারদের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়ে তারা দায় এড়িয়ে চলেন।
অনেক আশা প্রত্যাশার আয়কর আইন-২০২৩ (২০২৩ সালের ১২নং আইন)-এর ৭৬ ধারায় নাগরিকদের ট্যাক্স নির্ধারণের ক্ষমতা আমলাদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা বলা যায় জমিদারি প্রথার ধারাবাহিক কায়দা। যার কারণে কর্তারা ইচ্ছা করলে কোনও ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স কমিয়ে দিতে পারে আবার ইচ্ছা করলে ট্যাক্সের জালে আটকে হয়রানি করতে পারে। আর এ কারণেই হাজার হাজার মতিউর তৈরি হচ্ছে স্বাভাবিক গতিতেই।
সরকার কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না, কী করে এই মতিউরদের দমন করা যায়। মূলত কোনও নাগরিক কী পরিমাণ কর দেবে সেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আমলাদের হাতে থাকে বলেই অনিয়ম হওয়া স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গেছে।
মূলত স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি কোনও সরকার এই রাজস্ব খাতের নিয়ন্ত্রণে বা বিধিবদ্ধ কাঠামো তৈরিতে জোর দেননি। সময় যত যায় রাষ্ট্রের দায় তত বাড়ে। নাগরিকদের চাহিদা যেমন বাড়ে, তেমনি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সমীকরণের সঙ্গে তাল মিলাতে হয় রাষ্ট্রকে। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব যেমন বাড়ে তেমনি বাড়ে ব্যয়ের পরিমাণ। এই ব্যয় নির্বাহের জন্য নাগরিক ট্যাক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন যেমন তেমনভাবে রাজস্ব বাড়ানোর চিন্তা না করে এই খাতে ব্যাপক মেধা যেমন বিনিয়োগ করতে হবে, তেমনি করতে হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা। নাগরিকরা দিনশেষে তার দেয় ট্যাক্সের সদ্ব্যবহার দেখতে চায়। যখন তারা দেখেন তাদের কষ্টের দেওয়া ট্যাক্স নিয়ে নয়-ছয় হয়, অপথে কুপথে ব্যয় হয়, লুটতরাজ হয় বা পাচার হয়, তখন করদাতারা মারাত্মকভাবে মনে কষ্ট পান। ধীরে ধীরে তারা কর পরিশোধ করতে অনীহা প্রকাশ করেন এবং অন্যদেরও নিরুৎসাহী করেন। এতে কর-জিডিপি বৃদ্ধিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া এখন প্রকাশ্যে আলোচনা হচ্ছে কর কর্মকর্তাদের সততা নিয়ে। তারা সত্যিকার অর্থে সৎভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা। হ্যাঁ, সবাই দুর্নীতিবাজ না, কিন্তু এমনভাবে পরিবেশটা তৈরি হয়েছে যে এখন গড়ে সবাইকে দুর্নীতির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ছাড়া নাগরিকদের আর উপায় নেই। যারা সরকার পরিচালনায় রয়েছেন তারাও অনেকটা বুঝতে শুরু করেছেন মনে হয়। এই বোঝা থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা জরুরি। না হলে এই নব্য জমিদাররা সরকারকে জনগণের মুখোমুখি করে ছাড়বে।
সম্প্রতি (২৫ জুন ২০২৪) কেনিয়ায় যে দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটলো (১০ জন নাগরিককে প্রাণ দিতে হলো, শত শত লোক আহত হলো), তা এই কর ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের জন্যই হলো। যেসব কারণে কেনিয়ার সরকারকে কর বৃদ্ধি করতে হলো, ঠিক একই কারণ আমাদের দেশেও বিদ্যমান। সমস্যা হলো কর-আদায়ে সরকারের কৌশল নির্ধারণে চরম ঘাটতি ছিল। যার ফলে নাগরিক অসন্তোষ দানাবেঁধে ওঠে। জনতার ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে কেনিয়ার সরকার কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে। এ ঘটনা থেকে আমাদের সতর্ক হওয়ার বার্তা নিতে হবে। সামনের দিনগুলো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে, জনগণের স্বাভাবিক জীবনমান আরও হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়।
মূলত সিদ্ধান্তটা নিতে হবে রাজনৈতিকভাবে। রাজস্ব বৃদ্ধি, নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রের মানদণ্ড ধরে রাখা, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিষয়ে সরকারের মনোযোগ বৃদ্ধি করা আবশ্যক।
এই পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারকে নিম্নবর্ণিত কিছু বিষয়ে মনোনিবেশ করার সুপারিশ করা যেতে পারে:
১. স্মার্ট কর ব্যবস্থাপনার দিকে দ্রুত এগোতে হবে, পুরো কর-ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা।
২. একজন কর-কর্মকর্তাকে ৬ মাসের বেশি একটি সার্কেলে বা জোনে দায়িত্ব পালন করতে না দেওয়া, অর্থাৎ ৬ মাস পর পর এক জোন থেকে অন্য জোনে বদলির ব্যবস্থা করা; এখানে অফিসের পুরো সেট লোকবল বদলির ব্যবস্থা করা। কারণ একই জোনে বা সার্কেলে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকায় সবাই মিলে একটা জোট গঠন করে দুর্বল করদাতাদের চিহ্নিত করে নানাভাবে হয়রানির চিত্র তৈরি করেন।
৩. একই সঙ্গে কর-কর্মকর্তাদের সম্পদের বিবরণী প্রতিবছর সরকারের অডিটর জেনারেল অফিসে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
৪. প্রত্যেক অফিসে একটা অভিযোগ বক্স রাখা, যাতে কোনও অফিস করদাতাদের হয়রানি করলে অভিযোগ দাখিল করতে পারে।
৫. করদাতা ইচ্ছাকৃত তার আয় গোপন করলে, উক্ত গোপন করা আয়ের ওপর সর্বোচ্চ হারে কর আদায়ের ব্যবস্থা করা।
৬. কর-ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য কর-আপিল আদালতগুলোতে জুডিশিয়াল বিচারক নিয়োগ দেওয়া।
৭. কর ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়নে নাগরিকদের অংশগ্রহণের জন্য ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালানো।
৮. প্রত্যেক জেলা পর্যায়ে ইউনিয়নভিত্তিক এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক কর-আইনজীবীদের দায়িত্ব দিয়ে প্রকৃতপক্ষে করজাল বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা; একই সঙ্গে টিআরপি বিধিমালা বাতিল করে কর আইনজীবীদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা; এতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি না করেই ব্যাপক হারে করদাতাকে করজালে আনা সম্ভব।
৯. আয়কর আইন ২০২৩-এর ৭৬ ধারা পর্যালোচনা করা, একটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া, যাতে বিদ্যমান অনিয়ম হ্রাস করা যায়।
লেখক: আইনজীবী, ঢাকা
sskbdtaxvat@gmail.com