সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু এসব কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়নি কিংবা সেই অর্থে সফলতাও পায়নি। যেকোনও আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে সফল হতে পারলেই তার ফল ঘরে তোলা যায়। কিন্তু বিএনপি দীর্ঘদিন থেকে তেমন কোনও সফলতা ঘরে তুলতে পারছে না। রাজনীতিতে ভুল থাকতে পারে। তবে বারবারের ভুলে রাজনীতি থেকে সটকে পড়তে হয়। সেটি হতে পারে রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে কিংবা রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে। আর রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, অভিযোগ-অনুযোগের বিষয়গুলো সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে সামনে এগোতে হয়। কিন্তু বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল হলেও এমন ব্যাকরণ মেনে চলতে মোটেও পারছে না। বিএনপির নেতাকর্মীদের ভেতর অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব এখন অনেক চাঙা হয়ে আছে।
সাধারণত কোনও দল ক্ষমতায় না থাকলে তাদের চেষ্টা করা উচিত নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া। তবে এক্ষেত্রে বিএনপি মোটেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না কিংবা সামনে এগোতে পারছে না। বরং তারা রাজনীতিতে বারবার ভুল করে একে অপরকে দোষারোপের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনের পর কারামুক্ত হওয়া কোনও কোনও নেতাকে ‘সন্দেহ’ করছেন গ্রেফতার না হওয়া নেতারা। কারাগারে যাওয়া সেসব নেতার বিষয়ে দল ও শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলছে ওই পক্ষটি। বিপরীতে সারা দেশে গণগ্রেফতার অভিযানের মধ্যেও জেলে না যাওয়া কোনও কোনও শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন কারাভোগকারী অনেক নেতা। এ পরিপ্রেক্ষিতে দলের প্রভাবশালী দু’পক্ষের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এমনকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের এক দফা দাবির আন্দোলনের ব্যর্থতা নিয়েও দোষারোপের রাজনীতি চলছে বিএনপিতে।
এ কথা সত্য যে বিএনপির আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক দফা দাবি আদায় করতে না পারলে দ্বিতীয় বিকল্প কী হবে- সে কৌশল নির্ধারণের দায়িত্ব দলের নীতিনির্ধারকের থাকলেও সেটি তারা করতে পারেনি। এই সময়ে এসে আন্দোলনে ব্যর্থতার ধুয়া তুলে দলের কমিটি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ মহানগর ও অঙ্গসংগঠন যুবদলের কমিটি গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। কোনও কোনও নেতাকে পদোন্নতি ও পদাবনতি করা হচ্ছে।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা যায়, এই মুহূর্তে বিএনপির সবচেয়ে বড় সংকট হলো নেতৃত্বের। ইতোমধ্যে বিএনপি বুঝতে পেরেছে যে তারেক জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন ফলপ্রসূ করার সম্ভাবনা মোটেই নেই। কারণ, ভূ-রাজনৈতিক বিচারে বিদেশে বসে দেশীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যে কারণে এত কিছুর পরও বিএনপির আন্দোলনের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে। কারণ, আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো এর সঙ্গে জনপ্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার।
রাজনীতিতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে, তবে বর্তমানে মতো বিএনপির দ্বিধাদ্বন্দ্ব এতটা আগে দেখা যায়নি। জনগণের কাছে কমিটমেন্ট না থাকলে রাজনীতিতে লাভবান হওয়া দুষ্কর। আপাতত বিএনপির কোনও দৃশ্যমান রাজনৈতিক কমিটমেন্ট নেই। এই মুহূর্তে তাদের আন্দোলনে যাওয়ার কোনও ইস্যু কিংবা জোরালো কোনও সুযোগ নেই।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বলা যায়, বেশ কিছু রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার বেড়াজালে নিজেদের আবদ্ধ করে ইতোমধ্যে তাদের জন্য বুমেরাং পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দলকে সুসংগঠিত করা, জনগণের সমর্থন আদায়, আন্তর্জাতিক সমর্থন তাদের পক্ষে নেওয়া প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তারা এখন ঘূর্ণিপাকে। নিজেদের ভুল সিদ্ধান্তে বারবার নিজেরাই হোঁচট খাচ্ছে।
পরিস্থিতির কারণে ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারালেও বিএনপিকে চেষ্টা করতে হবে তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে। কারণ রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। নেতৃত্বের সংকট কাটিয়ে বিএনপিকে টিকে থাকার পরিকল্পনা গ্রহণ এখন অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত। আবার কোনও পরিস্থিতি সৃষ্টি হতেই পারে, যাতে বিএনপির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে পারে। ইতোপূর্বে অনেক লেখাতে উল্লেখ করেছি, সরকার কখনোই চাইবে না তাদের জনপ্রিয়তা চলে যাক, আর বিরোধীরা অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠুক। ফলে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা ধরে রাখার বিষয়টিই মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। তবে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থীদের অংশ নিতে দেখা গেছে। এ বিষয়েও তাদের নিজেদের বিভেদ তৈরি হয়েছে। মূলত বিএনপি যে সিদ্ধান্তই নিচ্ছে সেটি তাদের জন্য ভুল হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে তারা অনেকটা ‘ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড এবং টু স্টেপস ব্যাক’ নীতির মতো করে চলছে।
অন্যদিকে ক্রমেই আওয়ামী লীগ সরকারের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য-বিবৃতি আত্মবিশ্বাসের বিষয়টি প্রমাণ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়েছে, প্রতিপক্ষ কিংবা বহির্বিশ্বের কোনও চাপে বর্তমানে সরকারের নেই। ইদানীং প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের এমন আত্মবিশ্বাসই বিএনপির জন্য ক্রমেই কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর সরকারের এই আত্মবিশ্বাসের বিষয়টিতে বিএনপির জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে। একদিকে সরকারের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, অন্যদিকে নিজেদের যথাযথভাবে মজবুত করতে না পারার দীর্ঘশ্বাস হচ্ছে বিএনপির।
প্রধানমন্ত্রী বারবারই বলে যাচ্ছেন, ‘দেশ এগিয়ে যাবে।’ এটি নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রীর নিজের মনের জোর ও সাহস। মূলত বিএনপি-জামায়াতের বিগত সময়ের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলেই এ শক্তি তৈরি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মনে। কাজেই প্রতিপক্ষকে বুঝতে হবে, আওয়ামী লীগ সরকার কোনও চাপের কাছে সহজে নতি স্বীকার করার পরিবেশ নেই। এই মুহূর্তে নিজেদের যতটা সম্ভব ছাড় দিয়ে এবং ঐক্যবদ্ধ থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে চাঙাভাব ফিরিয়ে আনা উচিত তাদের।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
sultanmahmud.rana@gmail.com