বিশ্ব যখন ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধ করার আবেদন নিবেদন নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখনই বিশ্বের আরেক প্রান্তে আরও একটি গণহত্যা চলমান আছে সেই ২০১৭ সালের পর থেকে, যা নিয়ে না জাতিসংঘ না বিশ্বমোড়লরা কোনও কার্যকর ভূমিকা রাখছে। বলছিলাম মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সেই দেশের সেনাবাহিনীর চলমান গণহত্যার কথা। ফিলিস্তিনে একজন যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহুর কথা বিশ্বের সবাই জানেন, কিন্তু মিয়ানমারে এই নেতানিয়াহুর সংখ্যা একাধিক। বিশ্ব সম্প্রদায়ের এটি চরম ব্যর্থতা যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর এই চলমান গণহত্যা নিয়ে তারা এখন তেমন একটা উচ্চবাচ্য করে না। প্রায় সবার কাছে এটি একটি বিস্মৃত অধ্যায়।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে যে গণহত্যার শুরু, বর্তমানে তা এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে, সেখানে এখন রোহিঙ্গাদের শিরশ্ছেদ চলছে। একদা আর্থসামাজিকভাবে উন্নত একটি দেশ এখন বর্বরতার ও ধ্বংসের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছে। জাতিসংঘ নামক একটি অকার্যকর বিশ্ব সংস্থার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তাদের প্রয়োজনীয়তাও সম্ভবত ফুরিয়ে গেছে।
দেশে ও দেশের বাইরে যখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে নানা ধরনের অপপ্রচারের মাধ্যমে একটি সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র চলমান, ঠিক তখনই জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মুখপাত্র ভলকার তুর্ক ক’দিন আগে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে অনুরোধ করেছেন নতুন শরণার্থীদের নিজেদের দেশে ঠাঁই দিতে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আনুমানিক ৪৫ হাজার শরণার্থী নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে জড়ো হয়েছেন। জাতিসংঘের কাছ থেকে এমন একটা অবিবেচক আহ্বান বাংলাদেশর জন্য সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
মিয়ানমার জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র, কিন্তু দেশটি শুধু জাতিসংঘের আইন-কানুনকেই শুধু লঙ্ঘনই করেনি, তারা প্রায় এক দশক ধরে জাতিগত উচ্ছেদ কার্যক্রম ও গণহত্যা চালিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। বড় বড় পরাশক্তিগুলোর প্রশ্রয় পেয়ে তারা বর্তমানে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মিয়ানমারে যখনই গণহত্যা বিষয়ক কোনও প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত হয়েছে, অবধারিতভাবে তাতে কোনও না কোনও স্থায়ী সদস্য ভেটো দিয়েছে। মিয়ানমারে যে দীর্ঘ গণহত্যা চলছে তার জন্য প্রত্যক্ষভাবে এসব পরাশক্তিও দায়ী। একই সঙ্গে দায়ী শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী মিয়ানমারের নেতা অং সান সু চি। এই সু চি’ই তো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আদালতে মিয়ানমারে চলমান গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বলে এসেছিলেন, এখানে কোনও গণহত্যা হচ্ছে না। নিয়তির নির্মম পরিহাস, সেই সু চি বর্তমানে নিজেই সামরিক জান্তার হেফাজতে।
২০১৭ সালে যখন মিয়ানমারের একশ্রেণির বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভয়াবহ জাতিগত সন্ত্রাসের কারণে শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা শুরু হয়েছিল, তখন মিয়ানমারের জান্তা সরকার তা বন্ধ করার কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ তো করেইনি; বরং তাতে শামিল হয়েছিল। তখন কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা আরাকান রাজ্য থেকে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন বাংলাদেশ ছাড়া মিয়ানমার সংলগ্ন আর কোনও দেশ এত উদারভাবে তাদের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়নি। ছুটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ভাগ্যাহত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন ‘এই দুর্যোগের সময় আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি’।
পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে, সীমান্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আর বিজিবির জোয়ানরা তাদের কাঁধে করে সীমান্ত অতিক্রম করে আসা বয়স্ক শরণার্থীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার দৃশ্য। কাতারভিত্তিক ‘আল জাজিরা’ নামক একটি মতলবি প্রচারমাধ্যম মাঝে মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অসত্য সংবাদ প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। সম্প্রতি তারা এমন এক প্রচারে বললো– বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নাকি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত। কাতারভিত্তিক এই প্রচারমাধ্যমটির জন্ম ১৯৯৬ সালে মার্কিন সহায়তায় মার্কিনিদের ইরাক দখলের সময়। তার আগে সৌদি আরব ও কাতার তাদের দেশে বিবিসি’র সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এরপর এই ‘আল জাজিরা’ ঘণ্টায় ঘণ্টায় মার্কিন সেনাদের ইরাক দখল করে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়’ তাদের ‘নাজায়েজ’ কর্মসূচির নির্লজ্জ প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা কখনও কিন্তু মিয়ানমারে চলমান গণহত্যার সংবাদ তেমন একটা প্রচার করে না।
২০১৭ সালে আসা সেই রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে কম করে হলেও চৌদ্দটি রাষ্ট্রে মোট ১৩ লাখ জনসংখ্যা নেই। এর অর্থ বাংলাদেশের মতো একটি ছোট জনবহুল দেশ নিজ দেশের ভিতরে প্রায় চৌদ্দটি দেশের মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। এক দেশের একটি ছোট অংশের ভিতর ১৪টি দেশ! ঘটনা যখন শুরু হয় তখন দেশ-বিদেশের অনেক রাজা-বাদশা-রাজকন্যা-রাজপুত্র থেকে শুরু করে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা, সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা ছুটে আসেন বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ভাগ্যবিড়ম্বিত শরণার্থীদের দেখতে। সবাই সেখানে গিয়ে আফসোস করে একটু ‘হায় হায়’ করে নিজ দেশে ফিরে যান। কক্সবাজারে প্রতিষ্ঠিত সেই শরণার্থী শিবিরগুলো রাতারাতি হয়ে ওঠে এক আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। সবাই যাওয়ার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পিঠ চাপড়ে বলে যান ‘বাহ আপনি চমৎকার কাজ করেছেন। আপনি মানবতার জননী’। একজনও বলেননি আমাদের দেশে আমরা কিছু শরণার্থী নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রচুর খালি জমি আছে, সেখানে তারা চাষাবাদ করে চলতে পারবে’। অথচ এই দেশগুলোর অনেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের জ্ঞাতি ভাইদের হাতে ইউরোপে নির্যাতিত নিপীড়িত ইহুদিদের জাহাজ ভর্তি করে নিয়ে এসে ফিলিস্তিনের আরবভূমিতে স্থানান্তর করে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত করে দিয়েছে। সেই অনৈতিক কাজের সহায়ক ছিল জাতিসংঘ আর মিয়ানমারে সংগঠিত চলমান গণহত্যার পরোক্ষ মদতদাতাও জাতিসংঘ। কক্সবাজারের টেকনাফ, কুতুপালং, উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া কয়েক হাজার শরণার্থীকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় নোয়াখালীর ভাসানচরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় নির্মিত নতুন আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই স্থানান্তর প্রকল্পের প্রায় পুরো অর্থায়ন করা হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকে। এই কথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে রাখে না। তারা শুধু বাংলাদেশকে আরও একটু মানবিক হওয়ার অযৌক্তিক অনুরোধ করে।
মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের পুঁজি করে লাভবান হচ্ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু এনজিও, যাদের কাজই হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে মানুষের দুর্দশার বেসাতি করে বিপুল পরিমাণের অর্থ সংগ্রহ করে প্রথমে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা, তারপর বাকি যা থাকে তা থেকে শরণার্থীদের কিছু বিলি-বণ্টন করা। কোনও দেশে যুদ্ধ লাগলে পরাশক্তিগুলোর লাভ। কারণ তাদের অস্ত্র বিক্রি বৃদ্ধি পায়, ঠিক একইভাবে যখন কোনও অঞ্চলে মানুষ কোনও দুর্যোগের মুখোমুখি হয় তখন এসব এনজিও’র জন্য অর্থ কামানোর নতুন দরজা খুলে যায়। অবশ্য এর মধ্যে ব্যতিক্রম নেই তা বলা যাবে না। মাঝে মধ্যে যখনই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ এসেছে ঠিক তখনই জাতিসংঘ নিরাপত্তার অজুহাত তুলে তাদের নিষেধ করেছে, তারা যেন ফেরত না যায়। অথচ জাতিসংঘ যদি আন্তরিক হতো, বলতে পারতো তারা আরাকান রাজ্যে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করে ফিরে যাওয়া শরণার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তা না বলে তারা অনুরোধ করে বাংলাদেশ যেন এই শরণার্থীদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ না করে। তারা উপলব্ধি করে না এখন এই শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে যে সহায়তা পাওয়া যেতো, তা এখন অনেকটা কমে এসেছে।
এরইমধ্যে বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গাদের জন্য সাত শত মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। এই ঋণ কি জাতিসংঘ পরিশোধ করবে, নাকি বাংলাদেশের জনগণের পকেট থেকে যাবে? এমন প্রশ্নের উত্তর কি জাতিসংঘ দেবে? ওই ঋণ বাংলাদেশের নিজস্ব প্রয়োজনে নেওয়া অন্য আরেকটি ঋণের শর্ত হিসেবে বাংলাদেশকে নিতে হচ্ছে। শরণার্থীরা বাংলাদেশ অবস্থান করলে লাভ অনেক পক্ষের। লোকসান শুধু বাংলাদেশের। গত কয়েক বছরে শরণার্থী শিবিরগুলো হয়ে উঠেছে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের অভয়ারণ্য। মানবপাচার চলছে দীর্ঘদিন ধরে। শরণার্থী শিবিরগুলো হয়ে উঠেছে সব ধরনের সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কয়েক শত একরের বন জঙ্গল উজাড় হয়েছে, বিপর্যস্ত হয়েছে পরিবেশ। এই শরণার্থীদের দীর্ঘ উপস্থিতির কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতা। যে দায় হওয়া উচিত ছিল সারা বিশ্বের, সেই দায় বর্তমানে বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশকে একা সামাল দিতে হচ্ছে। এই বিষয়ে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা কিন্তু একেবারেই নিশ্চুপ। এখন তারা ফিলিস্তিন নিয়ে ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মাঝেও তারা ভুলে গিয়েছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার নামক দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে আর একটি গণহত্যা চলমান আছে। বাংলাদেশের এখন উচিত স্পষ্ট ভাষায় জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে জানিয়ে দেওয়া বাংলাদেশ কোনও অবস্থাতেই এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে আর কোনও ধরনের সহায়তা করতে অপারগ। এটি বাংলাদেশের একক কোনও সমস্যা নয়। এই সমস্যা সমাধানের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশে আর কোনও দায় নিতে প্রস্তুত নয়। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক