গিগ ইকোনমি ও পরবর্তী প্রজন্ম

আমার ছোট মেয়ে তার এসএসসি পরীক্ষার পর আমাকে একটা ভালো ল্যাপটপ কিনে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। তার ট্যাব আছে কিন্তু সে সেটাতে সন্তুষ্ট নয়। বললাম ঠিক আছে, আমি কিনে দিবো, কিন্তু এক শর্তে। তোমাকে ফ্রিল্যান্সিং করে খুব দ্রুতই আমার টাকাটা পরিশোধ করে দিতে হবে। সে রাজি হলো।

আমি আইডিবি ভবনে গিয়ে আশি হাজার টাকা দিয়ে মোটামুটি ভালো মানের একটা ল্যাপটপ কিনে তাকে দিলাম। তারপর দেখলাম সে এক দেশি স্টার্টআপে অনলাইনে কাজ শুরু করলো। এবং কয়েক মাসের মধ্যেই আমার সব টাকা শোধ করে দিলো। তারপর শুনতাম সে মাঝে মাঝেই টাকা ইনকাম করছে।

এখন যেহেতু এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা কাছে চলে এসেছে সে আর তেমন কাজ করছে না। আমি সম্প্রতি তাকে জিজ্ঞাসা করে জানালো যে পরীক্ষার পর সে আবার কাজ করবে, তবে এই লাইনে কমপিটিশন বেশ বাড়ছে। দীর্ঘস্থায়ী জবে টিকে থাকা কঠিন। তাকে আরও স্কিলড হতে হবে বলে জানালো।  

বুঝতে পারলাম সে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনেকের মতো বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান গিগ ইকোনমির একজন কর্মী। প্রথমে মেয়ের টাকা ইনকামে খুশি হলেও পরে সে যে একজন গিগ ওয়ার্কার হিসেবে গড়ে উঠছে তা নিয়ে মাঝে মাঝে একটু চিন্তিতই হয়ে পড়ি। কারণ এগুলো দীর্ঘস্থায়ী কোনও চাকরি নয়। আবার বড় মেয়েটাও সিএসইতে পড়ছে। তার বিষয়ের কারণেই তাকেও সম্ভবত গিগ ওয়ার্কার হতে হবে। সুতরাং ভবিষ্যতের অনিশ্চিত পৃথিবীতে তারা কীভাবে টিকে থাকবে সেটা আমার জন্য একটা চিন্তার বিষয়। আর এভাবেই এ লেখার সূত্রপাত!

সবাই হয়তো জানেন যে গিগ ইকোনমিতে প্রথাগত স্থায়ী চাকরির পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি চুক্তি বা ফ্রিল্যান্সিং চাকরির ওপরে জোর দেওয়া হয়। ফ্রিল্যান্সার, রাইড শেয়ারিং ড্রাইভার, গ্রাফিক ডিজাইনার, অনলাইন টিউটর ইত্যাদি গিগ জবের উদাহরণ। ইদানীং দেশের পত্রপত্রিকায় গিগ ইকোনমি নিয়ে বেশ লেখালেখি হচ্ছে। তরুণদের গিগ ইকোনমির সুযোগ গ্রহণ করে ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। এটা ঠিক যে দেশে গিগ ইকোনমির পরিসর বাড়ছে। গিগ ইকোনমি নিয়ে আন্তর্জাতিক ডাটাবেজ গিগপিডিয়া অনুসারে, গিগ ইকোনমি থেকে বাংলাদেশ বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় করছে।

জার্নালিজমের শিক্ষক হিসেবে আমাদের বিভাগে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে কাজ করতে উৎসাহিত করি। আমাদের অনেক শিক্ষার্থীই এ ধরনের কাজে যুক্ত। মাসে কয়েক লাখ টাকা আয় করে আমাদের বিভাগে এরকম শিক্ষার্থীও আছে।

কিন্তু সর্বত্র অর্থনৈতিক দিকটি বেশি আলোচিত হওয়ায় গিগ ইকোনমির সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নীতিমালা সম্পর্কিত ব্যাপারগুলো কমই আলোচিত হচ্ছে। কম আলোচিত হচ্ছে গিগ ওয়ার্কারদের ভবিষ্যৎ নিয়েও।

আমি জানি আমার মতো অভিভাবকের পক্ষে, যারা দীর্ঘদিন ধরে নয়টা-পাঁচটা অফিস করে অভ্যস্ত বা দীর্ঘদিন এক চাকরি করে আসছেন, পরবর্তী প্রজন্মের এই নতুন ধরনের চাকরির সংস্কৃতি মেনে নেওয়া কঠিনই বটে! তারপরেও এ প্রজন্মের এক বিশাল অংশ tech-whiz হিসেবে গড়ে উঠছে, অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং করছে, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। কিন্তু তারপরও আমাদের মতো অভিভাবকদের অনেক শঙ্কা জাগে। অনেক প্রশ্ন জাগে পরের প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে।  

বিশ্বব্যাপী গিগ ইকোনমির প্রসার বাড়লেও উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কিছুটা পার্থক্য আছে। উন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন সোশ্যাল সেফটি নেট, যেমন- বেকার ভাতা, স্বাস্থ্যবিমা ইত্যাদি থাকার কারণে গিগ জবের ব্যাপারে সবার চাহিদা এবং আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু আমাদের দেশে তো সোশ্যাল সেফটি নেটের তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই। সরকারিভাবে সর্বজনীন পেনশনের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এখনও এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, বা এ বিষয়ে সব নাগরিকদের ধারণা পরিষ্কার না।   

গিগ ওয়ার্কারদের প্রতিমাসের আয়ের ব্যাপক তারতম্য থাকতে পারে। আবার মাঝে মাঝে দীর্ঘদিন কাজ ছাড়াও থাকতে হতে পারে। যেটি আমাদের মতো দেশের গিগ ওয়ার্কারদের জন্য একটি ব্যাপক দুশ্চিন্তার কারণ। ইচ্ছেমতো এবং সুযোগমতো কাজের সুবিধা থাকলেও তারা অনেক ক্ষেত্রেই গিগ ওয়ার্কাররা সনাতন অফিস কালচার থেকে বঞ্চিত হন। এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা থেকে তারা চাকরিদাতাদের কাছেও প্রতারিত হতে পারেন।

বলা হয়ে থাকে গিগ ইকোনমি একধরনের hustle culture জন্ম দিয়েছে। এক গিগ থেকে আরেক গিগ এভাবে সবসময় কাজ খোঁজা কঠিন এবং ঝামেলাপূর্ণ মনে হতে পারে। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সার্বক্ষণিক দক্ষতা বৃদ্ধির চাপ। অনেক গিগ প্ল্যাটফর্ম অ্যালগরিদম ব্যবহারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দক্ষ এবং পজিটিভ ক্লায়েন্ট রিভিউ আছে এরকম কর্মী খুঁজে বের করে।

দক্ষতা বৃদ্ধির তো কোনও শেষ নেই। একজন ওয়েব ডেভলপারকে এখন এসইও বা সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন শিখতে হচ্ছে। একজন গ্রাফিক ডিজাইনারকে আগে ফটোশপ বা ইলাস্ট্রেটর জানলেই চলতো। কিন্তু এখন তাকে টিকে থাকার লড়াইয়ে বিভিন্ন অ্যানিমেশন সফটওয়্যারেও দক্ষ হতে হচ্ছে।  আবার এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গিয়েছে। টিকে থাকতে গেলে এখন এআইয়ের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে দক্ষতায় পাল্লা দিতে হবে!

গিগ ইকোনমির সমালোচনা করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে আমি আমাদের দেশের গিগ ওয়ার্কাররা কীভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা সুযোগ সুবিধা পেতে পারেন সে ব্যাপারে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। গিগ ইকোনমির পরিসর দিনে দিনে বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিগ ওয়ার্কারদের বিভিন্ন অধিকার এবং তাদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যাপারে রাষ্ট্র এবং সরকারগুলো নজর দেওয়া শুরু করেছে।

গত বছর আগস্টে রয়টার্স খবর দিয়েছিল যে ভারত সরকার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম, যেমন- অ্যামাজন, উবার ইত্যাদিতে কর্মরত গিগ ওয়ার্কারদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক সুবিধা দিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্ঘটনা, স্বাস্থ্যবিমা, অবসরকালীন সুবিধা ইত্যাদি। ভারতের রাজস্থানের পর হরিয়ানায় গিগ ওয়ার্কারদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে আইন করা হচ্ছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়েছে।

গিগ ওয়ার্কারদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে প্ল্যাটফর্ম কোঅপারেটিভিজম কনসোর্টিয়াম বা প্ল্যাটফর্ম কোঅপ্টস নামে একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এটি অনলাইন বিজনেসের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা, প্রশিক্ষণ, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে গিগ ওয়ার্কারদের পক্ষে কাজ করে।

বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আইডি কার্ড ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রণোদনার ব্যাপারে মাঝে মাঝেই মিডিয়াতে বিভিন্ন খবর আসে। এসবের তো অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমার মনে হয় দেশের ক্রমবর্ধমান গিগ ইকোনমিতে অবদানের জন্য সরকারের উচিত গিগ ওয়ার্কারদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।

লেখক: কলামিস্ট, বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

ই-মেইলঃ shamsulbkk@gmail.com