সড়ক ও মহাসড়কে মোটরযানের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি ‘মোটরযান গতিসীমা নির্দেশিকা ২০২৪’ অনুমোদন করেছে। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ৪৪নং ধারা এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২-এর ১২৫নং বিধি (উপবিধি-৪)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বহুল প্রত্যাশিত এ নির্দেশিকা জারি করেছে। এটি সড়ক নিরাপত্তায় নতুন গতি আনবে আশা করা যাচ্ছে।
মোটরযানের অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া মোটরযান চালানোকে বাংলাদেশে রোড ক্র্যাশের অন্যতম কারণ। এ বিবেচনায় জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ৩.৬ অর্জনের নিমিত্তে এ নির্দেশিকায় গতি নিয়ন্ত্রণমূলক কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
এতে সড়কের শ্রেণি ও যানবাহনের শ্রেণি/ধরন অনুযায়ী ঘণ্টা হিসাবে সর্বোচ্চ গতি নির্ধারণ করা হয়েছে। সার্ভিস লেনসহ সড়ক ও মহাসড়কের চার বা ছয় লেনবিশিষ্ট বিভক্ত সড়ক এবং সার্ভিস লেন বাদে একমুখী রাস্তা ৯.৮ মিটার থেকে ১৩.৩৫ মিটার প্রস্থের সড়ককে এক্সপ্রেসওয়ে বলা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ের মতোই একই প্রস্থের সড়ক, যা সার্ভিস লেন ব্যতীত চার বা ছয় লেনবিশিষ্ট বিভক্ত সড়ককে এ-ক্যাটাগরির জাতীয় মহাসড়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুই লেনবিশিষ্ট সড়ককে দ্বিমুখী সড়ককে বি-ক্যাটাগরির জাতীয় বা আঞ্চলিক মহাসড়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর প্রস্থ ১০.৩ মিটার। জেলা সড়কের প্রস্থ ৬.৭ মিটার থেকে ৮.৫ মিটার বলে নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
মোটরকার, জিপ, মাইক্রোবাস ইত্যাদি হালকা যান এবং দূরপাল্লার বাস ও মিনিবাস ইত্যাদি মধ্যম ও ভারী যানের সর্বোচ্চ গতিসীমা এক্সপ্রেসওয়ে ও এ-ক্যাটাগরির জাতীয় মহাসড়কে ৮০ কিলোমিটার (কি.মি.), বি-ক্যাটাগরির জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৭০ কি.মি. এবং জেলা সড়কে ৬০ কি.মি.। ট্রাক, মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ইত্যাদি মালবাহী মোটরযান এবং ট্রেইলরযুক্ত আর্টিকুলেটেড মোটরযানের সর্বোচ্চ গতিসীমা এক্সপ্রেসওয়ে ও এ-ক্যাটাগরির জাতীয় মহাসড়কে ৫০ কি.মি., বি-ক্যাটাগরির জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪৫ কি.মি. এবং জেলা সড়কে ৪০ কি.মি. রাখা হয়েছে। চালকরা এই গতিসীমা মেনে নিজ নিজ মোটরযান চালালে নিজেদের (চালক ও সহকারী) এবং যাত্রীদের যাতায়াত নিরাপদ হয়ে উঠবে।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার যেমন বেড়েছে তেমনি এ বাহন ব্যবহারকারীদের মৃত্যুও অনেক বেড়েছে। মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিসীমা এক্সপ্রেসওয়েতে ৬০ কি.মি., এ ও বি-ক্যাটাগরির জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কে ৫০ কি.মি. নির্ধারণ করা হয়েছে। মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীরা এই গতিসীমা মেনে চললে নিজেদের বিপদের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনতে পারবেন।
বিভিন্ন মহাসড়কে দ্রুতগতির যানের মধ্যে স্বল্পগতির যান রোড ক্র্যাশের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। তাই গতি নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক এ নির্দেশিকায় সরকার সব ধরনের মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন নিষিদ্ধ করেছে। জেলা সড়কে এসব যান কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে সর্বোচ্চ ৩০ কি.মি. গতিতে চালাতে পারবে। বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কঠোরভাবে এই নির্দেশিকাসহ সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিমালা বাস্তবায়নে সক্রিয় হলে মহাসড়কগুলো ঝুঁকিপূর্ণ তিন চাকার যানমুক্ত হবে। যা সার্বিকভাবে সড়ক নিরাপদ করতে ভূমিকা রাখবে।
শহরের ক্ষেত্রে সব ধরনের যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা সদরের মধ্যে কমপক্ষে ৬ লেনবিশিষ্ট রাস্তার প্রস্থ ১০.৩ মিটার, পাশে ফুটপাত ও রাস্তা পারাপারে ব্যবস্থা বিদ্যমান এমন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক, অভ্যন্তরীণ সড়ক এবং উপজেলা মহাসড়ক (রাস্তার প্রস্থ ৭.৩ থেকে ১১ মিটার) মোটরকার, জিপ, মাইক্রোবাস ইত্যাদি হালকা যান এবং দূরপাল্লার বাস ও মিনিবাস ইত্যাদি মধ্যম ও ভারী যানের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কি.মি.। এসব সড়কে ট্রাক, মিনি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ইত্যাদি মালবাহী মোটরযান, ট্রেইলরযুক্ত আর্টিকুলেটেড মোটরযান এবং মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কি.মি.।
মোটরকার, জিপ, মাইক্রোবাস ইত্যাদি হালকা যান শহর এলাকায় অবিভক্ত ও দুই লেনবিশিষ্ট প্রাইমারি আরবান সড়কে সর্বোচ্চ ৪০ কি.মি. এবং মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ ৩০ কি.মি. গতিতে চলবে।
শহর এলাকায় সংকীর্ণ সড়ক/শেয়ার রোড ও অন্যান্য অবিভক্ত ও দুই লেনের সড়কে মোটরকার, জিপ, মাইক্রোবাস ইত্যাদি হালকা যান এবং ট্রাক, মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ইত্যাদি মালবাহী মোটরযানের গতি ৩০ কি.মি. এবং মোটরসাইকেলের গতি ২০ কি.মি. নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এ সড়কে যাত্রীবাহী দূরপাল্লার বাস ও মিনিবাস ইত্যাদি মধ্যম ও ভারী যান এবং ট্রেইলরযুক্ত আর্টিকুলেটেড মোটরযান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জনবহুল এবং মিশ্র ধরনের সড়কে চলাচল করলে শিশুসহ পথচারী, বাইসাইকেল চালক, রিকশার মতো ছোট পরিবহন ব্যবহারকারীদের ঝুঁকি বাড়ে।
তিন মিটার থেকে ৩.৭ মিটার প্রস্থের গ্রামীণ সড়কে মোটরকার, জিপ, মাইক্রোবাস ইত্যাদি হালকা যান, মোটরসাইকেল ও তিন চাকার যানের সর্বোচ্চ গতি ৩০ কি.মি. নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সড়কে সব ধরনের ভারী যান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শহরের সড়কগুলোতে তিন চাকার যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ৩০ কি.মি. এবং শুধু সংকীর্ণ ও শেয়ার রোডে এই গতি ২০ কি.মি. নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সড়কগুলোতে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের পরামর্শ ও বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, শহরের মতো জনবহুল এলাকায় যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণে সরকার গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
আশা করা যায়, সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসিত হবে। গতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের এ নির্দেশিকা সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোড ক্র্যাশ ও সড়কে অকাল মৃত্যু অনেক কমে আসবে, যা এসডিজির সংশ্লিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের মতো জরুরি পরিষেবায় নিয়োজিত যানবাহনের গতিসীমা শিথিলযোগ্য করা হয়েছে। এছাড়া বিআরটিএ কর্তৃক নির্ধারিত সর্বোচ্চ এই গতিসীমা স্বাভাবিক অবস্থায় বিদ্যমান থাকবে। দুযোগপূর্ণ আবহাওয়া, প্রখর রোদ, অতিরিক্ত বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা ইত্যাদি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণযোগ্য ও নিরাপদ হবে। এ নির্দেশিকায় ঘন কুয়াশা বা অন্য কোনও কারণে দৃষ্টিসীমা কমে গেলে বা একেবারে দেখা না গেলে যান চলাচল বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ে, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক, জেলা সড়কসহ সব সড়কের উভয় দিকের প্রবেশমুখ ও নির্দিষ্ট দূরত্বে যানবাহনভিত্তিক নির্ধারিত গতিসীমা সংক্রান্ত সাইন রাস্তা নির্মাণকারী বা উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবে। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকা, বাঁক, আঁকাবাঁকা সড়ক, ব্রিজ, ব্রিজ বা লেবেল ক্রসিং, সংযোগস্থল, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সামনে সাইনে প্রদর্শিত গতিসীমা প্রদর্শন করতে হবে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান সড়ক ও সেতু নির্মাণ করে, যেমন- সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি), সেতু কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ ইত্যাদি। যে প্রতিষ্ঠান যে সড়ক নির্মাণ করবে সে প্রতিষ্ঠান সেই সড়কে যানবাহনের শ্রেণি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সড়কে গতিসীমা উল্লেখ করে সাইন স্থাপন করবে। এক্ষেত্রে সড়কে বাঁক, জাংশন, জ্যামিতিক কাঠামো, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে মোটরযানের শ্রেণি/ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য ট্রাফিক সাইন ম্যানুয়াল অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড ট্রাফিক সাইন পোস্ট ও গতিসীমা প্রদর্শন ও স্থাপন করবে। বিআরটিএ পরবর্তী সময়ে সড়কের পরিবেশ ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে নিরাপদ এবং মানসম্মত স্থানীয় গতিসীমা নির্ধারণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনাসহ তা বাস্তবায়ন এবং প্রয়োগের বিভিন্ন ধাপ/উপায় সংবলিত একটি সহায়ক ম্যানুয়াল প্রণয়ন করবে। এ ম্যানুয়াল যত দ্রুত করা হবে ততই মঙ্গল।
সবশেষে এ নির্দেশিকায় মালবাহী মোটরযানসহ স্বল্পগতির মোটরযান সর্বদা বামে চলাচল করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাম লেনে ওভারটেকিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ডান লেনে ওভারটেকিংয়ের ক্ষেত্রে ট্রাফিক সাইন, রোডমার্কিং দেখে, সামনে ও পিছনে প্রয়োজনীয় জায়গা থাকলে নিরাপদ পরিস্থিতি বিবেচনায় ওভারটেকিং করা যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সড়ক নিরাপত্তায় সর্বজনীন স্লোগান হচ্ছে Slow drive, save lives. বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে ‘ধীরে চলুন, জীবন বাঁচান’ ব্যবহৃত হয়েছে ও হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে ‘মোটরযান গতিসীমা নির্দেশিকা ২০২৪’ সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়। এ নির্দেশিকার বহুল প্রচারে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। চালক ও যাত্রীদের এই নির্দেশিকা সম্পর্কে জানানো হলে এসব গতিসীমা অনেকে অনুসরণ করবে বলে আমার বিশ্বাস। তারপরও যারা এ গতিসীমা মানবে না তাদের আইনের আওতায় আনার মাধ্যমে এই নির্দেশিকা বাস্তবায়ন করা হলে সড়কে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অকাল মৃত্যু কমে আসবে।
সড়কের গুরুত্বকে আমরা অস্বীকার করতে পারবো না। কারণ, বিশ্বব্যাপী মানুষের যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনে সড়ক নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে। উন্নয়নে একটি দৃশ্যমান উদ্যোগ হচ্ছে সড়ক, সেতু ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণ। যে কারণে প্রায় সব দেশেই সড়ক ও যানবাহন দুটোই বাড়ছে। কিন্তু একই হারে যেন রোড ক্র্যাশ, পঙ্গুত্ব ও অকাল মৃত্যু না বাড়ে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সেজন্য যানবাহনের গতিসীমার এ নির্দেশিকার বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।
পাদটীকা: বাংলাদেশে সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা খুবই কম হয়। গতিসীমা নির্দেশিকা প্রণয়ন করায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ। আশা করি বাংলাদেশ পুলিশ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বিআরটিএ এই নির্দেশিকার সফল বাস্তবায়ন করবে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কোষাধ্যক্ষ, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন