শিশুদের নৈতিক শিক্ষা কি নির্বাসনে গেলো?

বন্ধু বন্ধুকে পিটিয়ে মারে, ছাত্র শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে, আবাসিক হলে নারীনেত্রীরা সাধারণ ছাত্রীদের রাতভর নির্যাতন করে, রাষ্ট্রীয় বাসে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস ভাঙচুর করা, এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে ধাক্কা দিয়ে উপরের তালা থেকে নিচে ফেলে দিচ্ছে, মারামারি করে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে হাসপাতালে পাঠাচ্ছে, ক্যাম্পাসের আশপাশের মার্কেটগুলোতে চাঁদাবাজি করছে, ক্যাম্পাসে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া– এরকম আরও অনেক সংবাদ আমরা পত্রিকায় দেখতে পাই।

এই খবরগুলো মফস্বলের কোনও অখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নয়, খোদ দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, এই ধরনের অপকর্মে জড়িতদের সবাই এই সময়ের মেধাবী শিক্ষার্থী। চরম প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভর্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই তারা এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে।  

প্রশ্ন আসতে পারে, মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও তারা কেন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে? একবাক্যে এই উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে একটি কারণকে আমরা হলফ করে বলতে পারি। তা হচ্ছে নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার অভাব। আমাদের কাছে এখন এ প্লাস অথবা জিপিএ ফাইভ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান ভালো মানুষ হচ্ছে কিনা এটা এখন গৌণ। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির দৃশ্যমান অধঃপতন।

এই অধঃপতন একদিনে হয়নি, ধীরে ধীরে হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উভয় জায়গায় নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হতো। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয় না, পরিবার থেকেও নৈতিক শিক্ষার রেওয়াজ আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে আমরা যতটা উদ্বিগ্ন, নৈতিক-মানবিক বোধের উত্তরণ নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন না। এ কারণেই আমাদের শিশুরা মানব না হয়ে পরিণত হচ্ছে শিক্ষিত দানবে।  

শৈশবে প্রাথমিক স্কুলে আমরা পড়েছি– ‘সদা সত্য কথা বলিব, সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি- সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি, সকলের তরে সকলে আমরা- প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’। এই ধরনের নীতিবাক্য, কবিতা, অথবা ছড়া শিক্ষক বলতো, আমরা তাল মিলিয়ে জোরে জোরে বলতাম। মনের অবচেতনে এই নীতি কথাগুলো একসময় গেঁথে যেত। ছোটবেলায় শেখানো এই শিক্ষাগুলো এখনও বহু মানুষকে সত্য পথের দিশা দেয়।  

অথচ এই নীতিবাক্যগুলো বর্তমানে ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। এখন শিশুরা পড়ে– ‘টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার’ অথবা ‘হাট্টিমাটিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম’– এ জাতীয় ছড়া। আমি এগুলোর বিপক্ষে নই, এসব ছড়ারও প্রয়োজন আছে। তবে এসব ছড়ার সঙ্গে যদি কিছু নীতি শিক্ষামূলক ছড়া কবিতা শেখানো হয়, তাহলে শিশুদের নৈতিক শিক্ষার ভিত আরও উন্নত হবে– এটা যে কেউই স্বীকার করবেন।  

ইতিহাসে পেছনে তাকালে আমরা দেখতে পাই, এখানকার সমাজ ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি ছিল নৈতিক শিক্ষা। গুরুমুখী ধর্মীয় শিক্ষালয়ে অন্য ধর্মের ছাত্ররাও পড়াশোনার সুযোগ পেতো। ইংরেজরা ক্ষমতা দখলের পর প্রথমদিকে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছিলেন না। তারা বুঝলেন– এ অঞ্চলের মানুষের মূলশক্তি হচ্ছে নৈতিক শিক্ষা, এই নৈতিক মেরুদণ্ড না ভাঙতে পারলে এ জাতিকে পদানত করা অসম্ভব।

তাই সংস্কারের নামে নৈতিক শিক্ষা ব্যবস্থার বদলে চাপিয়ে দেওয়া হলো পশ্চিমা কারিক্যুলাম। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল– একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকে পশ্চিমা অনুকরণে বৈশ্বিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে ইংরেজ সরকারের অনুগত কেরানি বানানো। আগে যেখানে শেখানো হতো– চুরি করা মহাপাপ, অন্যের অনিষ্ট করো না, ওজনে কম দিও না, সেখানে চাপিয়ে দেওয়া হলো অনৈতিক ও অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু। এক লিটার দুধে আধা লিটার পানি মেশালে কত টাকা লাভ হবে? বানর ও পিচ্ছিল বাঁশের গণিত ইত্যাদি।

তারপর ধর্মশিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষা নামে সমাজে দুটি শ্রেণি তৈরি করা হলো। ধর্মের মূল শিক্ষা অর্থাৎ সদাচরণ, নৈতিকতা, পরার্থপরতা ও মানবিকতার শিক্ষা থেকে একটি অংশকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হলো। আবার যারা ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতো, তাদের বাস্তবমুখী বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হলো। উদ্দেশ্য ছিল– নীতিহীন দক্ষ মানুষ, অথবা দক্ষতাহীন ভালো মানুষ তৈরি করা, যাতে গোলাম বানিয়ে রাখা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে যে বহুধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত, তা মূলত ইংরেজদের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমরা ইংরেজ সরকারের অপকর্মকেও হার মানিয়েছি।  

নীতিশিক্ষা বাদ দিলে, সমাজের কি দশা হয় তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮০ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হতো। শিশুদের নৈতিক বিকাশের জন্য প্রতিটি স্কুলে Fulghum’s rule-এর চর্চা হতো। Fulghum’s rule হচ্ছে নীতিশিক্ষার (করণীয় বর্জনীয়) লিখিত দিকনির্দেশনা। জাপানি শিশুদের তুলনায় আমেরিকার শিশুরা পিছিয়ে যাচ্ছে এই শঙ্কা থেকে তারা পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনলো। নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে অ্যাকাডেমিক বিষয়ের ওপর বেশি জোর দেওয়া হলো।

এর ফলে সমাজ ব্যবস্থায় একটি নেতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হলো। স্কুল অথবা মা-বাবা থেকে আদব কায়দা শেখার পরিবর্তে শিশু তার বন্ধুদের কাছ থেকে বেয়াদবি ও অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি রপ্ত করতে শুরু করলো। বর্তমান অবস্থা আরও শোচনীয়। এখন শিশুরা মা-বাবা থেকে বন্ধুবান্ধবকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তরুণদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আমেরিকার সমাজব্যবস্থায় এক ধরনের বিপর্যয় স্পষ্টত দৃশ্যমান।  

অন্যদিকে জাপানের স্কুলগুলোতে নৈতিক এবং সামাজিক শিক্ষার ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হলো। কনফুসিয়াসের নৈতিক দর্শন দ্বারা জাপানের সমাজব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। সেখানে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উভয় জায়গাতেই আদব কায়দা শিষ্টাচার ও সামাজিক রীতিনীতি শেখানো হয়। শিশুদের সামাজিক ভদ্রতা, নৈতিকতা এবং দায়িত্ববোধ শেখানো হয় কিন্ডারগার্টেন বা ডে-কেয়ার থেকে। ফলশ্রুতিতে জাপান পরিচিতি পেলো প্রযুক্তিদক্ষ বিনয়ী মানুষের দেশ এবং অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে।  

ঠিক এরকম পথেই আমাদের এগোতে হবে। শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। অভিভাবকরা শিশুদের নৈতিক শিক্ষা অর্থাৎ ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, আদব কায়দা, বিনয়, শালীনতা, শিষ্টাচার, মানবিকতা ইত্যাদি শিক্ষা দেবেন। পাঠ্যপুস্তকেও যুক্ত করতে হবে এ ধরনের শিক্ষা। শুধু তাই নয়, চর্চার মধ্যেও নৈতিকতাকে নিয়ে আসতে হবে। পরীক্ষায় অন্যের খাতা দেখে নকল করা, অনুমতি ব্যতীত অন্যের জিনিস ব্যবহার করা যে অন্যায় তা শিশুকে বলতে হবে।

শেখাতে হবে– সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। পিকনিকের জন্য একদিন স্কুলে যেতে না পারলে, পরদিন শিশুকে শারীরিক অসুস্থতার দরখাস্ত দিয়ে স্কুলে পাঠাবেন না, বরং পিকনিকের কথা উল্লেখ করেই দরখাস্ত দিতে উৎসাহিত করবেন। এর ফলে শিশুরা শিখবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে সত্য বলতে হয়।  

যদি নির্বাসিত এই নৈতিক শিক্ষাগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারি, তবেই স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে আমাদের কাছে দৃশ্যমান হবে।

লেখক: প্যারেন্টিং গবেষক

ইমেইল- shamolatiq@gmail.com