কোথা থেকে এলো ‘মার্কিন’

বিশ্বের সবচেয়ে প্রতাপশালী দেশ এখন কোনটি? পাড়া-মহল্লার একজন চা দোকানদারও জানেন এর উত্তর। যদিও দেশটির পুরো নাম হয়তো বলতে পারবেন না তিনি। পুরো নামটি ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। বাংলায় আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র। সংক্ষেপে শুধুই যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির যে কোনও ব্যক্তি, স্থান, মুদ্রা, নীতি ইত্যাদি বোঝাতে আমরা হরহামেশাই ব্যবহার করি ‌‌‘মার্কিন’ শব্দটি। বক্তব্য, বিবৃতি, বই, পত্রপত্রিকা বা বিভিন্ন প্রকাশনায় অহরহ মিলে এই শব্দ। কিন্তু কেন এই মার্কিন শব্দটি ব্যবহার করছি, কী তার অর্থ, কীভাবে কোথা থেকে এলো এটি– তা বেশিরভাগ মানুষই আসলে জানি না। মার্কিন শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে বেশ কিছু ধারণা বা ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। চলুন জেনে যাওয়া যাক তার কয়েকটা–

American থেকে Merkin!

কেউ কেউ বলে থাকেন, মার্কিন শব্দটি ইংরেজিতে উচ্চারিত হয় Merkin (mɑ:rki:n) হিসেবে। শব্দটি এসেছে American (æmerɪkɑ:n) থেকে। American (আমেরিকান) শব্দটিই নানাভাবে পরিবর্তিত অথবা বিকৃত হয়ে Merkin রূপ পেয়েছে। ইন্দো-ইউরোপীয় উৎস থেকে আর্য, প্রাকৃত স্তর অতিক্রম করে ‘গৌড়ীয় কিংবা মাগধী অপভ্রংশ (বিকৃত)’ হয়ে অসংখ্য শব্দ যেমনিভাবে  বাংলা ভাষায় রূপ পেয়েছে,  এটাও অনেকটা তেমনই।  এক্ষেত্রে American ‍এর প্রথম ও শেষের A দুটি বাদ পড়েছে। হয়েছে mericn। তারপর C এর পর বসেছে। অক্ষরটি। পরে আবার C বদলে এসেছে K। শেষমেস দাঁড়িয়েছে Merkin (মার্কিন)। কিন্তু এত বিকৃতি ঘটে একটা শব্দের উচ্চারণ পুরোপুরি ভিন্ন একটা রূপ কীভাবে পেল তা খুবই রহস্যজনক বিষয়। অনেকের মতে, American শব্দটি যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয়রা ম্যারিকান উচ্চারণ করে থাকেন। সেটিই উচ্চারণচ্যুতি ঘটতে ঘটতে হয়ে গেছে মার্কিন। তবে এই রূপান্তরের বিষয়টি শুধুই প্রচলিত একটি ধারণা। এর যথাযথ কোনও ব্যাখ্যা বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে পাওয়া যায় না।

কাপড়ের প্রচলন থেকে?

ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে আমেরিকা থেকে এক ধরনের সুতি কাপড় আমদানি করা হতো। ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তা পরিচিতি পায় মার্কিন কাপড় হিসেবে। কারও কারও মতে, এই ‘ম্যারিকান কাপড়’ আঞ্চলিক উচ্চারণগত জটিলতায় এক সময় হয়ে যায় ‘মার্কিন কাপড়’। তবে কবে কীভাবে কাপড়ের নাম ম্যারিকান থেকে মার্কিন হয়ে গেলো– সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনও তথ্য জানা যায় না।

জাতীয় পতাকার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার যুক্তি 

অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকাই মার্কিন শব্দের মূল উৎস। তারা বলছেন, দেশটির পতাকায় রয়েছে ৫০টি রাজ্যের জন্য ৫০টি স্টার বা তারা। আর ব্রিটিশ শাসনাধীন থেকে স্বাধীন হওয়া ১৩টি কলোনির জন্য রয়েছে ১৩টি সাদা-লাল স্ট্রাইপ বা ডোরা। পতাকার ৫০টি তারাকে বলা হয় ‘মার্ক’।  ১৩টি স্ট্রাইপ  হচ্ছে ‘ইন’। ‘মার্ক’ এবং ‘ইন’ এর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে মার্কিন শব্দ, যা দিয়ে ইউনাইটেড স্টেট অব আমেরিকা (ইউএসএ) বা যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়কে বোঝানো হয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটিও আসলে ধারণা প্রসূত। কারণ ১৭৭৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইউনাইটেড স্টেট অব আমেরিকার পতাকার ডিজাইন বদলেছে অনেকবার। বর্তমান যে ডিজাইনটি আছে তা ২৭তম সংস্করণ। প্রথমদিকে তারার সংখ্যা ছিল ৪৮টি। পরে হয় ৪৯টি। আর ৫০টি হয়েছে ১৯৫৯ সালে। তার মানে ৫০টি এসেছে অনেক পরে। কাজেই স্টার দিয়ে মার্কিন শব্দের উৎপত্তির যুক্তি কতটা শক্ত সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়।

নামের পেছনে কি মার্ক অব কর্নওয়াল

মার্কিন নামের পেছনে ঐতিহাসিক একটা গল্প আছে বলে মনে করেন অনেকে। তারা বলছেন, ষষ্ঠ শতকে ব্রিটিশ অঞ্চলে কর্নওয়াল রাজ্যের অধিপতি ছিলেন মার্ক। এই মার্কের বংশধররাই পরবর্তীতে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা দখলে নিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের শাসনব্যবস্থা। এর পরিপ্রেক্ষিতেই রাজা মার্কের নামানুসারে মার্কিন শব্দটি এসেছে। কিন্তু এই গল্পের তথ্যগত ভিত্তি খুবই দুর্বল। একথা সত্য যে, কর্নওয়াল থেকে কর্নিশ জাতির অনেকেই আমেরিকায় গিয়ে বসত গড়েন। আমেরিকায় তাদের ভালো একটা অবস্থানও আছে। যেমন, Harry S. Truman, Franklin Delano Roosevelt সহ যুক্তরাষ্ট্রের মোট তিনজন প্রেসিডেন্টের বাবা অথবা মায়ের দিক থেকে কেউ না কেউ কর্নিশ জাতির। অবশ্য তাদের মধ্যে Truman নিজেকে কর্নিশ পরিচয় দিতেই রাজি ছিলেন না। সে যাই হোক, এই কর্নিশদের আসলে কয়জন মার্কের বংশধর এবং আমেরিকা গড়ে ওঠার ইতিহাসে তাদের প্রভাবই বা কতটা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে মার্ক থেকে মার্কিন হওয়ার এই গল্পের পেছনে তথ্যভিত্তিক শক্ত কোনও যুক্তি পাওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রাচীন, মধ্য কিংবা আধুনিক কোনও যুগেই এই মার্কওয়ালাদের আমেরিকা গড়ে ওঠার পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা জানা যায় না। তাই মার্ক থেকে পুরো ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার মানুষ, মুদ্রা বা অন্য কোনও কিছুকে মার্কিন বলা যাবে কিনা সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।

অভিধানে কী আছে

ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে মার্কিন শব্দটি এত বেশি প্রচলিত হয়েছে যে, এটি বাংলা অভিধানেও ইতোমধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘মার্কিন’ শব্দটির অর্থ বলা হচ্ছে-আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত কোরা সুতোর তৈরি মোটা কাপড় বিশেষ, যুক্তরাষ্ট্রসমন্ধীয় এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত। এছাড়া মার্কিনদেশ অর্থ লেখা আছে- আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। তবে বাংলা একাডেমিরই ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারিতে Merkin বলে কোনও শব্দই নেই।

যুক্তরাষ্ট্র অথবা যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ইংরেজি অভিধানগুলো ঘেটে দেখলেও এ নিয়ে অনেকটা হতাশই হতে হয়। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ক্যামব্রিজ ইংলিশ ডিকশনারিতে মার্কিন শব্দটি নেই। ব্রিটিশ অভিধান কলিন্স ডিকশনারি এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত মেরিয়াম-ওয়েবস্টার ডিকশনারির আধুনিক সংস্করণগুলোতে Merkin শব্দটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তবে আমরা যে অর্থে এই শব্দ ব্যবহার করি, ওই দুটি অভিধানে দেওয়া অর্থের সঙ্গে তার তিল পরিমাণ মিলও নেই।  সেখানে মার্কিন অর্থ দেওয়া হয়েছে অনেকটা এমন- False or artificial hair for the pudendum/ a public wig/ the pudendum itself. কাজেই অভিধানগুলো ঘেটে  দেখা যাচ্ছে– যে অর্থে মার্কিন শব্দটি আমরা বলছি বা লিখছি, তা আসলে বাংলাদেশ বা এ অঞ্চল ছাড়া আর কোনও জায়গায় ব্যবহার হয় না। 

প্রচলিত ধারণাগুলো নয় তথ্যনির্ভর

মার্কিন শব্দটি কী, কেন এবং কীভাবে এলো সে সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা বা ব্যাখ্যাগুলোর কোনোটিই যথেষ্ট প্রামাণিক তথ্য বা যুক্তিনির্ভর নয়। তবে যাই হোক, কোনও না কোনোভাবে মার্কিন শব্দটি আমাদের বলা বা লেখায় স্থান পেয়ে গেছে এটাই সত্য। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তি, স্থান, মুদ্রা বা অন্য কোনও কিছু বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহারে কোনও সমস্যা নেই। এ নিয়ে কেউ আপত্তি জানিয়েছেন এমনটিও শোনা যায় না।  এটি এখন বহুল প্রচলিতও।  আমরা জানি,  একেকটি ভাষা একেকটি বহমান স্রোতের মতো।  কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন ভাষায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন শব্দ। বাংলাতে মার্কিনও তেমন একটি।  

তবে কেউ কেউ বলছেন, ‌‌মার্কিন শব্দের পরিবর্তে ‘যুক্তরাষ্ট্রের’ অথবা ‘ইউএস’ ব্যবহার করাই ভালো। তাদের মতে, মার্কিন অর্থ আসলে কী এবং কোথা থেকে এর উৎপত্তি হয়েছে– সেটা যেহেতু আমরা জানি না, তাই এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অথবা ইউএস ব্যবহারই শোভন। যেমন– ‘যুক্তরাষ্ট্রের বা ইউএস প্রেসিডেন্ট’, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বা ইউএস ডলার’- এভাবেও বলতে বা লিখতে পারি আমরা।   

লেখক: ডেপুটি বিজনেস এডিটর, দৈনিক সমকাল