কেউ কেউ খুব ছোটবেলা থেকেই নিজের কাজ নিজেই করে কিংবা স্বনির্ভর ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠে। আত্মবিশ্বাসে এবং পরিবারের সদস্যদের সহযোগী মনোভাব এই বেড়ে ওঠার পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। পরিবারের পরিবেশেরও এখানে ভূমিকা আছে। আবার অনেক শিশু আত্মনির্ভরশীল হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, যখন মা-বাবা তাকে অতি আদরে পরনির্ভরশীল করে ফেলে। যেমন ঘরের যে কাজগুলো খুবই সামান্য, সে কাজগুলো পর্যন্ত তাদের করতে দেয় না। যার কারণে তারা কিছুই শেখে না, এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে অলসতা বোধ করে। বড় হতে হতে একপর্যায়ে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে।
শিশুকাল থেকে কিশোরকাল পর্যন্ত তাকে কোনও কাজই করতে দেয়নি বাবা-মা। ফলে শিশুটির মধ্যে কাজ না করার অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেছে। বড় হয়ে সে যখন মুখোমুখি হচ্ছে বাইরের জগতের বাস্তবতার সাথে, তখন সে আর সেই সামাজিকতার দায়িত্বের ভার নিতে পারছে না। কারণ, ঘরের বাইরে যে বাস্তবতা, সেই বাস্তবতার সঙ্গে তার কোনও পরিচয় নেই। সে তো ঘরের ছোটখাটো কাজই কখনও করেনি। বড় হয়ে সেই মানুষগুলোর পক্ষে নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করাটা একটু দোটানার হয়। জীবন সংগ্রামে এই মানুষগুলো অনেক ভাবে, কোন দিকে যাবে? কাজের গতি নির্ধারণে হকচকিয়ে যায়। লক্ষ করলে দেখা যায়, খুব কম মানুষই আছে, যারা এমন পরিস্থিতির মধ্যেও নিজেকে তৈরি করতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার মনোবল তার মধ্যে সঠিকভাবে তৈরি হয়নি। কারণ, তাকে কখনোই কাজ করতে শেখানো হয়নি। শুধু তার পড়াশোনার প্রতিই বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। আগের দিনে নানা-নানি, দাদা-দাদির কাছে শিশুরা গল্প শুনতো। এর মধ্য দিয়ে কিছু ভুল সংশোধন করতে পারতো। কিন্তু এখনকার শিশুরা চার দেয়ালে বাবা-মা আর সে। ব্যস্ততার জীবনে কারো কোনও সময় নেই একটু মন খুলে কথা বলার। তাই শিশু বাড়ন্ত বয়সে এসে বুঝতে পারে না সে কী চায়?
কিছু শিশু বড় হয়ে যাওয়ার পর ছোটবেলার অনেক স্মৃতি বা ঘটনা ভোলে না। সেই স্মৃতি হৃদয়ে নিয়েই বড় হতে থাকে। একপর্যায়ে অনেক উন্নতি করলেও সেই স্মৃতির ঘোর তাকে তাড়া করে বেড়ানোর কারণে। সুখ বা সরলতাকে সহজ করে দেখতে পায় না প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর। সবটাই জটিল বাস্তবতার নিরিখে সোজা করে ভাবতে পারে না। কঠিন করে ফেলে নিজের জীবন।
শিশুকালের অভিযোগগুলো বড়বেলাতেও মনে রেখে দেয়। ছাড়তে পারে না। ফলে সে যখন সংসার জীবনের দায়িত্ব নেয়, তার সঙ্গে সমঝোতা তৈরি হয় না অন্যদের। বড় কঠিন সেই হিসাব। এই ভাবনাটা ভীষণ প্রয়োজন, শিশু একা থাকতে থাকতে স্বার্থপর যেন না হয়ে যায়, দোটানার মন যেন তৈরি না হয় সেদিকে খেয়াল দিতে হবে এবং শিশুকাল থেকেই ভাবনাটা সহজ করে দেওয়া দরকার।
শিশুর স্বাভাবিক জীবনের জন্য এখনকার বাবা-মায়ের অনেক ভূমিকা প্রয়োজন। শুধু পড়াশোনা নয়, আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর ওপরও বেশি লক্ষ রাখা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
শিশুর সঙ্গে সময় কাটানো বর্তমান যুগে সবচেয়ে বড় কাজ। আগের দিনে সময় না দিতে পারলেও যৌথ পরিবারের কথোপকথন, একসঙ্গে কোনও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখা, একসঙ্গে টেবিলে এক সময়ে খাওয়া– শিশুর বেড়ে ওঠার দাবিটা পূরণ হতো। তাতে পরিবারের সদস্যদের আচরণ বিধিবিধান, ব্যবহার সম্পর্কে দায়িত্বের ধারণা নিতে পারতো শিশুরা। কিন্তু এখনকার গল্প পাল্টে গেছে, চাহিদা বেড়েছে, ছোট ছোট ঘর তৈরি হয়েছে। তাই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের উচিত নিয়ম করে প্রত্যেক সদস্যের খোঁজ এবং দায়বদ্ধতার আলোকে নিজেকেই নিয়োজিত রাখা। যেহেতু বাবা-মা ছেলেমেয়ে যে যার ঘরে নিজের মতো থাকে, খাবার খায় একা, মোবাইল জীবনে অভ্যস্ত, তাই কেউ কারও খবর জানতে পারে না। ঘরকে বানাতে হবে আনন্দ নিকেতন। শিশুর নানা প্রশ্নের উত্তর নিজের মতো করে বাবা-মায়ের কাছে জানতে চায়, তাকে জানাতে হবে। সমস্যার সমাধানে তাদের সহযোগিতা চাইতে হবে। মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে।
সে কারণেই বলছিলাম, এ যুগের ছেলেমেয়েদের একদম ছোটবেলা থেকেই টুকটাক কাজের সাহস দেওয়া ভীষণ জরুরি বিষয়। তাতে করে সন্তান বড় হতে হতে দায়িত্ব কিছুটা হলেও নিতে শিখবে। দোটানার মন কম তৈরি হবে, ইগো একটি বড় রোগ, একাকিত্বে ইগো তৈরি হয়। বাবা-মাকে তা বুঝতে হবে। সন্তান আঘাত করে কথা বলা বা নিজের ভুলকে বাবা-মায়ের কর্তব্যের অবহেলার জরিপে ফেলতে পারার অকারণ সাহস করতে যেন না পারে। তার জন্য শাসন আর ভালোবাসার মধ্যে সমবণ্টনের খেয়াল রাখতে হবে।
দোষ খোঁজা দোটানা মানুষের স্বভাব। নানারকম মনোজগতের বিষয় থেকে যতটা পারা যায় সরলতায় ফিরাতেই হবে। তা না হলে এখনকার বাবা-মা আরও সমস্যায় পড়বে। অন্ততপক্ষে সকালটা আর রাতের কিছুটা সময় পরিবারকে দিতেই হবে। সবাই মিলেই কাজ করতে হবে। ঘরের কাজের বিকল্প কিছু নেই। মনের চাপ কমায় কাজ, দায়িত্ব বাড়ায় কাজ। শুধু ঘরের কাজই বড় ওষুধ।
দায়িত্বশীল আত্মনির্ভরশীল একজন হয়ে বেড়ে ওঠার জন্য, সুস্থ মানসিকতা তৈরি হওয়ার জন্য আপন ঘরকে আপন করো আরও। সন্তানকে বড় করো, ছোট ছোট আলোক বাণীতে। কাজের খেলাতে ঘরকে সাজাও। একে অপরের পারস্পরিক বক্তব্য শোনার চেষ্টা করো, সম্মান করো পরিবারের ছোট-বড় প্রত্যেক সদস্যকে। যাতে কেউ যেন অবহেলিত বোধ না করে। শুধু শিক্ষিত হলেই চলবে না, তার সঙ্গে সামাজিকতা, মিশতে পারা, স্বপ্নের লক্ষ্যে পৌঁছানোর মতো আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বাবা-মা’র দায়িত্ব নিজেদের তৈরি করা, যাতে শিশুর মনকে বুঝতে যেন মনের বোঝা বেড়ে না যায়।
লেখক: সংগীতশিল্পী