অর্থনীতির দুরবস্থা কাটবে কবে?

টাকা ছেপে তারল্য সহায়তার পরও দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট কাটছে না। এখনও গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারছে না এসব ব্যাংক। আগের সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। এতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে।

এদিকে ব্যাংক ঋণে সুদহার বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা প্রসারসহ থমকে রয়েছে নতুন বিনিয়োগ। ব্যবসা ও বিনিয়োগে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বেশির ভাগ উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করায় ব্যাংক ঋণের সুদ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এলসি খোলার হার কমেছে ৭ শতাংশ, আর উৎপাদন কমেছে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। আগের সরকারের আমলের অর্থপাচার, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও লুটপাটে বিপর্যস্ত এই অর্থনীতির দুরবস্থা কাটছে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার ৫ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো গেলেও এখনও ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, শিল্পে শ্রম অসন্তোষ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে জুলাই ও আগস্টে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চরম বিঘ্নিত হয়। জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। আগস্টে বিভিন্ন কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপর দেশজুড়ে শুরু হয় বন্যা। কয়েক মাস ধরে শিল্পাঞ্চলে বেতন বৃদ্ধি ও অন্যান্য দাবিকে কেন্দ্র করে অশান্ত পরিস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যেও রেমিট্যান্সের অবস্থা ভালো। সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বরে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার বা ২৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে।

রফতানিতেও প্রবৃদ্ধি রয়েছে। সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বর মাসে দেশে পণ্য রফতানি থেকে আয় এসেছে ৪৬২ কোটি ৭৪ লাখ মার্কিন ডলার। বছরের ব্যবধানে যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বছর শেষে মোট রিজার্ভ বেড়ে ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে চাল, ভোজ্যতেলসহ আরও কয়েকটি নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক-কর কমিয়েছে। এলসি মার্জিন কমানোসহ আমদানিতে সহায়তার কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি ঠেকানো যাচ্ছে না। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এছাড়া পুঁজিবাজারে সংস্কার শুরু হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকার পরিচালন ব্যয়ে লাগাম টেনেছে। সংস্কারের ফলে আগামীতে অর্থনীতি ভালোর দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। তবে ডলারের বাজারে অস্থিরতার মতো পুরনো সংকটগুলো নতুন বছরেও অর্থনীতিকে ভোগাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে শিল্প খাতের সংকট হবে আরও প্রকট হতে পারে। এছাড়া বাজারে টাকার প্রবাহ আরও কমতে পারে, এতে আরও বাড়তে পারে ঋণের সুদহার, আর সুদহার বৃদ্ধি মানেই বাধাগ্রস্ত হবে বিনিয়োগ, এতে কমবে নতুন কর্মসংস্থানের গতি।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৬ মাসের মধ্যে বর্তমানের দ্বিগুণের কাছাকাছি ঠেকবে বলে সতর্ক করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছি। সামনে খেলাপি ঋণ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে, এখন যা সাড়ে ১২ শতাংশ। আগামী মাসে তা ১৫ শতাংশ, এরপর ১৭ শতাংশ হয়ে ধীরে ধীরে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে।’ তিনি উল্লেখ করেন, এই খেলাপি আগেই হয়ে আছে। এখন তা হিসাবে আসবে। এটা কমিয়ে আনতে আমরা কাজ শুরু করেছি।

এদিকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অর্থনীতি মোটামুটি স্ট্রং তো হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বলবো না সব ক্ষেত্রে এটা হয়েছে। ব্যাংক সেক্টরে কিছু শৃঙ্খলা ফিরেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করছে, কিছু কিছু দুর্বল ব্যাংককে সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, এখন দরকার স্থিতিশীলতা।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা কাটতে আরও সময় লাগবে। তিনি বলেন, ‘আগামী এক-দেড় বছরে রাজনীতি কোন দিকে যায়, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা। আবার কারা ক্ষমতায় যেতে পারে, তা-ও তারা বিবেচনায় রাখছেন।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালজুড়েই অর্থনীতি ছিল দুর্দশার মধ্যে। মূলত অর্থনীতিতে সংকট শুরু হয় ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। তখন থেকেই লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন হতে থাকে। গত এপ্রিলে নিট রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের (আইএমএফের হিসাব) নিচে নামে। শুধু তাই নয়, বিগত কয়েক বছরে দেশ থেকে অর্থপাচার ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে ডলারের দাম বৃদ্ধির চাপ তৈরি হয়। ডলার সংকটে সরকারের জরুরি আমদানিও বাধাগ্রস্ত হয়। সার ও জ্বালানি আমদানিতে মেয়াদোত্তীর্ণ বকেয়া বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো বাংলাদেশের ঋণমান কমাতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বলতা প্রকাশ হতে থাকে। এমনকি গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে-পরে বেশ কিছু দিন অর্থনীতির স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এর ফলে অর্থনীতির কার্যক্রমে গতি আরও কমে যায়। এর সঙ্গে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আর্থিক খাতে বিশেষত ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের দুর্দশার চিত্র আরও স্পষ্ট হয়। এর সঙ্গে শিল্পাঞ্চলে অশান্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। সব মিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দেয় ধীরগতি। সরকার পতনের পর ঢাকার আশপাশে প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোয় ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। চলে অক্টোবর পর্যন্ত।

জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রা সংকোচন নীতির মাধ্যমে বাজারে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু সেটার সফলতা আসেনি। উল্টো মুদ্রাস্ফীতি বেড়েই চলছে। আবার পোশাক খাতে শ্রম অসন্তোষসহ নানামুখী সংকটে আগামী দিনে রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এই খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, একদিকে উৎপাদন খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে, অপরদিকে বিদেশি ক্রেতারা তাদের তৈরি পোশাকের দাম কমিয়ে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রেতারা রফতানি হওয়া বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমিয়েছেন প্রায় ৫ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম প্রায় ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে। বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে পোশাক খাতের ১০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না অন্তত ১৫৮টি কারখানা। ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর—এই ১০ মাসে ক্রেতারা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম কমিয়েছে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিরাপত্তার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েক মাসে আমাদের অনেক মালিক ঠিকমতো কারখানা চালাতে পারেননি। এসব কারণে বায়ারদের কনফিডেন্স কিছুটা কমে গেছে। সেই সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পক্ষের নানা রকম ষড়যন্ত্র রয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘একদিকে ক্রেতারা দাম কমিয়ে দিয়েছে, অপরদিকে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে উদ্যোক্তাদের খরচ বেড়ে গেছে।’ এই অবস্থায় এখন নতুন বিনিয়োগের কথা কেউ চিন্তা করছে না বলেও জানান তিনি।