প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার উদযাপিত হয় ‘বিশ্ব ডিম দিবস’। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) উদযাপিত হচ্ছে দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য হলো— ‘প্রতিদিন একটি ডিম, পুষ্টিময় সারাদিন’। ডিম দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর সূত্রে জানা গেছে, ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বর্তমানে বছরে দুই হাজার কোটি ডিম উৎপাদিত হচ্ছে। ২০৪১ সালে এই উৎপাদন সাড়ে চার হাজার কোটিতে পৌঁছাবে।
প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠন, ডিমের খাদ্যমান ও পুষ্টিগুণ সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা, একই সঙ্গে ভোক্তার দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ডিম অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করাই ডিম দিবস পালনের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল, ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি সায়েন্সেস অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে দেশে ডিম দিবস পালিত হচ্ছে।
দিবসের ইতিহাস
জানা গেছে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশন (আইইসি) স্থাপিত হয় ১৯৬৪ সালে। ডিমকে বিশ্বে একটি উন্নতমানের ও সহজলভ্য আমিষজাতীয় খাদ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই গঠিত হয় এই কমিশন। বর্তমানে এই সংস্থার সদস্য সংখ্যা ৮০টি। সংস্থাটি প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠন এবং সর্বোপরি ডিমের গুণাগুণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রথম ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালনের আয়োজন করে। যা পরবর্তী সময়ে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারতসহ সারা বিশ্বের ৪০টি দেশে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব ডিম দিবস’, যার পরিধি ও ব্যাপ্তি দিন দিন বাড়ছে।
জানা গেছে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশনের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের ডিম শিল্পের উন্নয়নে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। দিবসটির গুরুত্ব অনুধাবন করে ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশন ও এফএও’র তত্ত্বাবধানে এবং সহযোগিতায় সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন- বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প কেন্দ্রীয় কমিটি (পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল-বিপিআইসিসি), বাংলাদেশ অ্যানিমেল অ্যাগ্রিকালচার সোসাইটিসহ অনেক সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে ঢাকাসহ সবগুলো বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে উৎসাহের সঙ্গে দিবসটি নিয়মিত পালন করে আসছে।
উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পুষ্টিমান অনুসারে, বছরে একজন মানুষকে কমপক্ষে ১০৪টি ডিম খেতে হবে। এর বেশি হলেও ক্ষতি নেই বলে জানিয়েছেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে বছরে ডিমের উৎপাদন দাঁড়াবে চার হাজার ৬৪৮ কোটি ৮ লাখ পিস। বর্তমানে বাংলাদেশে ডিমের উৎপাদন বছরে দুই হাজার ৫৭ কোটি ৬৪ লাখ পিস।
জাতিসংঘের মা ও শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে দেশে হাঁস-মুরগির পরিমাণ বাড়ছে। ২০১৬-১৭ সালে দেশে মোট হাঁস-মুরগির পরিমাণ ছিল ৩২৯ কোটি ২০ লাখ। পাঁচ বছর পর ২০২০-২১ সালে এসে দেশে হাঁস-মুরগির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬৫ কোটি ৮৫ লাখ। যা থেকে বছরে ডিম উৎপাদন হচ্ছে দুই হাজার ৫৭ কোটি ৬৪ লাখ পিস। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, আগামী এক দশকে যে কয়টি আমিষ বা প্রাণিজপণ্যের জনপ্রতি প্রতিদিনের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়বে, তার মধ্যে এগিয়ে থাকবে ডিম, মাংস ও দুধ। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ অধিদফতর।
পুষ্টিমান
পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিমের পুষ্টিগুণ নির্ভর করে ডিমের আকার ও ওজনের ওপর। একটি ডিমে প্রায় ছয় গ্রাম প্রোটিন, পাঁচ গ্রাম উন্নত ফ্যাটি এসিড, ৭০ থেকে ৭৭ কিলোক্যালরি শক্তি, ১০০ থেকে ১৪০ মিলিগ্রাম কোলিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে। এছাড়াও ডিমে থাকা লিউটিন ও জেক্সানথিন চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ডিমের একটি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট প্রভাব রয়েছে। এতে এটি নিজেই জারিত হয়। এর ফলে কোষগুলো অক্সিডিটিভ স্ট্রেসের ধ্বংসকারী প্রভাবগুলো থেকে রক্ষা করে। ডিমে থাকা ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন হৃদরোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে।
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, দেশি মুরগির ডিম আর ফার্মের মুরগির ডিম এর মাঝে তেমন পুষ্টিগত কোনও পার্থক্য নেই। দেশে সাধারণত দেশি মুরগি ছেড়ে দিয়ে পালন করা হয়। এজন্য এদের খাদ্য তালিকায় থাকে বিভিন্ন রকম পোকা-মাকড়, গাছের কচি পাতা, কেঁচো ইত্যাদি। এজন্য দেশি মুরগীর ডিমে পুষ্টিগুণ বেশি হয়।
অপরদিকে ফার্মের মুরগিকে মাঝে মাঝে নানা রকম ভিটামিন খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সেসব খাবারে থাকে নানা রকম খনিজ পদার্থ। যেমন- শামুকের গুঁড়া, খৈল, লবণ, শুটকি মাছের গুঁড়া, ভুষি, গম, ভুট্টা আরও অনেক কিছুর সংমিশ্রন। এসব খাবারের কারণে ফার্মের মুরগির ডিমও পুষ্টিকর হয়। আবার দেশি মুরগির তুলনায় ফার্মের মুরগির ডিম আকারে বেশি বড় হয়। এসব দিক বিবেচনা করলে ফার্মের মুরগির ডিমেই বেশি পুষ্টি থাকে।
পুষ্টিমূল্যের দিকে বিচার করলে হাঁসের ডিম এবং মুরগির ডিমের পুষ্টিগুণও প্রায় একই। তবে হাঁসের ডিমে পুষ্টির পরিমাণ সামান্য বেশি। ১০০ গ্রাম হাঁসের ডিমে ১৮১ কিলোক্যালরি শক্তি থাকে। প্রোটিন থাকে ১৩.৫ গ্রাম, ফ্যাট ১৩.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৭০ মিলিগ্রাম, লোহা ৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ২৬৯ মাইক্রোগ্রাম। তবে ফ্যাট যারা কমাতে চান, তাদের জন্য মুরগির ডিমটাই বেশি উপযোগী।
পৃথিবীতে যত প্রকার খাদ্য উপযোগী ডিম আছে, তার মধ্যে কোয়েল পাখির ডিম গুণে মানে এবং পুষ্টিতে সর্বশ্রেষ্ঠ। ৪০ বছর পার হলেই ডাক্তাররা মুরগির ডিম খেতে নিষেধ করে থাকেন, সেটা ব্রয়লার মুরগির ডিম হোক বা দেশি মুরগির ডিম যেটাই হোক। কারণ, নিয়মিত মুরগির ডিম খেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়, ফলে হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম রেজাউল করিম বলেন, ‘দেশে ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। আগামীতে এর উৎপাদন আরও বাড়বে। শারীরিক পুষ্টি সরবরাহে ডিমের ভূমিকা অনেক। প্রতিটি মানুষকে দিনে একটি ডিম খাওয়া উচিত, যদি তার কোনও শারীরিক সমস্যা না থাকে। ডিমের উৎপাদন বাড়াতে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যা চলমান রয়েছে।’
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন