প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে লাভ ১২ টাকা?

তিন বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অথচ দেশের বাজারে এই সয়াবিন তেল এখন বিক্রি হচ্ছে তুলনামূলক উচ্চ দামে। নানা অজুহাতে সয়াবিন তেল পরিশোধনকারী মিল মালিকেরা প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে ব্যবসা করছেন ১২ টাকা, যা অস্বাভাবিক। ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং যথাসময়ে ব্যাংকের সহায়তা না পাওয়ায় বিশ্ববাজারে দর কমার সুফল পাচ্ছেন না দেশের ভোক্তারা।

বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত মাসিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে ২০২২ সাল থেকে সয়াবিন, পাম অয়েল ও সয়াবিন বীজের দাম নিম্নমুখী। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের গড় দাম ছিল ১ হাজার ৬৬৭ ডলার। ২০২৩ সালে সে দাম নেমে আসে ১ হাজার ১১৯ ডলারে। ২০২৪ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ২২ ডলারে। চলতি ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসেও সয়াবিনের দাম এর কাছাকাছি। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সয়াবিনের গড় দাম ছিল ১ হাজার ৪০ ডলার। এপ্রিল মাসে দাম আরও কমতে শুরু করেছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে একই চিত্র পাম অয়েলের ক্ষেত্রেও। ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে প্রতি টন পাম অয়েলের গড় দাম ছিল ১ হাজার ২৭৬ ডলার। ২০২৩ সালে ছিল মাত্র ৮৮৬ ডলার। ২০২৪ সালে দাঁড়ায় ৯৬৩ ডলার। চলতি ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে পাম অয়েলের গড় দাম ১ হাজার ৬৮ ডলার। এপ্রিল মাসে আবার কমতে শুরু করেছে এর দাম।

তথ্য অনুযায়ী, সয়াবিন বীজের দাম কমেছে সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালে প্রতি টন সয়াবিন বীজের গড় দাম ছিল ৬৭৫ ডলার। পরের বছর আরও কমে তা দাঁড়ায় ৫৯৮ ডলারে। ২০২৪ সালে আরও কমে বিক্রি হয়েছে ৪৬২ ডলারে। চলতি ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে আরও কমেছে সয়াবিন বীজের দাম। এই তিন মাসে গড় দাম ছিল ৪০৮ ডলার। সয়াবিন বীজ মাড়িয়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ভোজ্যতেল পাওয়া যায়।

এদিকে কাস্টমসের শুল্কায়ন মূল্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ৬ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে অপরিশোধিত যে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে, তার শুল্কায়ন মূল্য ছিল প্রতি কেজি গড়ে ১৩৬ টাকা। প্রতি কেজি অপরিশোধিত সয়াবিনের পরিবহন ও পরিশোধন ব্যয় সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ টাকা। শুল্ক, কর ও ভ্যাট বাবদ আরও ২১ টাকা যুক্ত করলে প্রতি লিটার ভোজ্যতেলের উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ১৭৭ টাকা। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার প্রতি লিটারে ১৪ টাকা বাড়িয়ে সয়াবিন তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৮৯ টাকা। এই হিসাবে প্রতি লিটারে অন্তত ১২ টাকা লাভ করছেন ব্যবসায়ীরা। এটি খুবই অস্বাভাবিক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া দাম ওঠানামার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে ভোজ্যতেলের দাম চার-পাঁচবার ওঠানামা করেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকারের সঙ্গে কোনও ধরনের আলোচনা ছাড়াই ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে দেন আমদানিকারকরা। তখন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৪ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১৭৩ টাকা। এরপর ১ মার্চ ১০ টাকা কমিয়ে প্রতি লিটারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৬৩ টাকা। এরপর ওই বছরের ১৮ এপ্রিল প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬৩ টাকা থেকে ৪ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ১৬৭ টাকা।

একইসঙ্গে খোলা সয়াবিন তেলের লিটার ১৪৯ টাকা থেকে কমিয়ে ১৪৭ টাকা করা হয়। এরপর গত ৯ ডিসেম্বর বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১৭৫ টাকা। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি লিটার ১৫৭ টাকা। এরপর সরকার আমদানিতে দুই দফায় শুল্ককর ছাড় দিয়েছে। চলতি বছরের ৩১ মার্চ এই ছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ফের লিটারে ১৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে সয়াবিন তেলের দাম।

বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভোজ্যতেলের চাহিদা বাড়লেও ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। এখন এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বড় পাঁচ শিল্প গ্রুপ। তাদের দাবি অনুযায়ী তেলের দাম বাড়ানো হয়। তাদের হাতেই বাজারের নিয়ন্ত্রণের মেকানিজম।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাব বলছে, এই ৫টি প্রতিষ্ঠানের হাতে রয়েছে আমদানিকৃত ভোজ্যতেলের ৭০ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড ও স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস। 

এনবিআরের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে প্রায় ২৫ লাখ ৭ হাজার টন সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানি করা হয়। ২০২৪ সালে আমদানি হয় প্রায় ৩২ লাখ টন ভোজ্যতেল। দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা এখন প্রায় ৩০ লাখ টন। ভোজ্যতেল পরিশোধনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, দেশে রিফাইনারি রয়েছে ২২টি। এর মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়টি কোম্পানি ভোজ্যতেলের অধিকাংশ চাহিদা পূরণ করছে।

শিপিং এজেন্টের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে অপরিশোধিত সয়াবিন, পাম অয়েল ও সয়াবিনের বীজ নিয়ে গত সাড়ে তিন মাসে জাহাজ এসেছে ২৩টি। এসব জাহাজে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েল এসেছে ৩ লাখ ৭ হাজার ২৮৫ টন। সয়াবিন বীজ এসেছে ২ লাখ ২৭ হাজার টন।

২০২৫ সালে সবচেয়ে বেশি ভোজ্যতেল এনেছে টিকে গ্রুপ। ফেব্রুয়ারিতে ৪টি জাহাজে প্রায় ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েল এনেছে গ্রুপটি। মার্চ মাসেও সর্বাধিক আমদানি করেছে তারা। এই সময় তাদের পাঁচটি জাহাজে পণ্য এসেছে প্রায় ৮০ হাজার টন। একই মাসে মেঘনা গ্রুপের পণ্য এসেছে প্রায় ৬৫ হাজার টন।

তবে ১৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত ভোজ্যতেলের কোনও জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসেনি। সূত্র দাবি করছে, দাম বাড়ার বিষয়টি আগাম নিশ্চিত হওয়ার পর ২ এপ্রিল থেকে আবার আমদানি শুরু করেন ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সয়াবিন, পাম ও সয়াবিন বীজ নিয়ে ৭টি জাহাজ নোঙর করে চট্টগ্রাম বন্দরে। আমদানিকৃত এসব ভোজ্যতেলের বেশিরভাগই কেনা হয়েছে ২০২৪ সালে, যখন আন্তর্জাতিক বাজারের গড় দাম ছিল সর্বনিম্ন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক অমিতাভ চক্রবর্তী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজার দর ও উৎপাদন খরচ সমন্বয় করে দেশীয় বাজারে দাম নির্ধারণ করা হয়। সেখানে অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ নেই।’