পোশাক রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রে কমছে চীনের আধিপত্য, জায়গা নিচ্ছে বাংলাদেশ

বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোশাক আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে বাজারচিত্র। এক সময় যে বাজারে চীনের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল, সেখানে এখন জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল উৎপাদক দেশগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটিইএক্সএ) সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৫৪০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার। ওই সময় চীনের রফতানি ছিল ২ হাজার ৭৩৭ কোটি ১০ লাখ ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।

কিন্তু ছয় বছরের ব্যবধানে সেই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করেছে ৭৩৪ কোটি ২৮ লাখ ডলারের পোশাক, যা ২০১৮ সালের তুলনায় ১৯৪ কোটি ২০ লাখ ডলার বেশি। অপরদিকে, একই সময়ে চীনের রফতানি কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৫০ কোটি ৭৪ লাখ ডলারে, অর্থাৎ ১ হাজার ৮৬ কোটি ৪৮ লাখ ডলার কম।

ফলে এখন চীনের রফতানি বাংলাদেশের তুলনায় শুধু দুই গুণের সামান্য বেশি। এমন বড় ব্যবধানের এতটা সংকোচন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান শক্ত অবস্থানকেই ইঙ্গিত করে।

যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় বছরে বাজার দখলে দ্রুত এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তান। সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ছয় বছরে (২০১৮-২০২৪) যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রফতানি কমেছে ৩৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। শুধু তাই নয়, মোট পোশাক আমদানির বাজারেও ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশের পতন ঘটেছে। অর্থাৎ, বাজার ছোট হলেও চীনের অংশীদারত্ব কমেছে সবচেয়ে বেশি, আর সেখান থেকে সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান উৎপাদক দেশগুলো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ, উচ্চহারে শুল্ক আরোপ, এবং সরবরাহ চেইনে বৈচিত্র্য আনার কৌশল এসব পরিবর্তনের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

এ প্রসঙ্গে বলেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘বাজারের এই পরিবর্তন প্রমাণ করে, বাংলাদেশ এখন আর শুধু সস্তা শ্রমের দেশ নয়; বরং একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। আমাদের দক্ষতা, মান নিয়ন্ত্রণ এবং সময় মতো ডেলিভারির কারণেই ক্রেতারা এখন বাংলাদেশমুখী।’

বিশ্লেষকদের মতে, এই গতি ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশকে আরও প্রযুক্তিনির্ভর ও টেকসই উৎপাদনের দিকে যেতে হবে। পাশাপাশি বহির্বিশ্বে ব্র্যান্ডিং এবং পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধিও জরুরি হয়ে উঠেছে।

মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘ট্যারিফ যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এটাই প্রমাণ করে যে, সঠিক পরিকল্পনা, গুণগতমান ও সময়নিষ্ঠ সরবরাহের মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন বিশ্ববাজারে নির্ভরযোগ্য নাম। আমাদের এই অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে পরিবেশবান্ধব এবং প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনের মাধ্যমে।’

ট্যারিফ যুদ্ধেই শুরু পরিবর্তনের গল্প

২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করলে পাল্টা ব্যবস্থা নেয় বেইজিং। শুরু হয় বাণিজ্যযুদ্ধ। পোশাকসহ নানা খাতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আমদানি নির্ভরতা চীন থেকে সরিয়ে নিতে থাকে।

সেই বছর যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রফতানি ছিল ২ হাজার ৭৩৭ কোটি ১ লাখ ডলার, যা ২০২৪ সালে নেমে এসেছে মাত্র ১ হাজার ৬৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলারে। বিপরীতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ৫৪০ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ৭৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারে।

পাকিস্তান-কম্বোডিয়ারও চমক

ওটিইএক্সএ-এর তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে ভিয়েতনামের মার্কেট শেয়ার বেড়েছে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ, ভারতের ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে পাকিস্তান (৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ) এবং কম্বোডিয়ার (৫৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ)।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্যারিফ যুদ্ধের পাশাপাশি কোভিড-পরবর্তী সরবরাহ চেইনের নতুন কাঠামো তৈরির চেষ্টাও এই পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন আরও বৈচিত্র্যময় উৎস থেকে পোশাক আমদানিতে আগ্রহী, যাতে নির্ভরতা কমে এবং পণ্যের সরবরাহ নির্বিঘ্ন থাকে।

বাজার কমেছে, তবু এগিয়ে দক্ষিণ এশিয়া

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মোট পোশাক আমদানির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ২৮৮ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারে। অর্থাৎ বাজারে ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ পতন হয়েছে। তবু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। অবশ্য বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানিতে চীনের অংশীদারত্ব ২১ শতাংশ, যা বিগত এক দশকে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তান দ্রুত সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে বৈচিত্র্য আনা এবং নির্ভরযোগ্য উৎসের সন্ধানে পশ্চিমা ক্রেতারা এখন চীনমুখী নয়। এক্ষেত্রে কম শুল্ক, শ্রমবান্ধব পরিবেশ এবং প্রতিযোগিতামূলক দাম বাংলাদেশের বড় সুবিধা হয়ে উঠতে পারে।

ইতিমধ্যে গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমশ মজবুত হচ্ছে। শ্রমঘন, দক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা এবং টেকসই ফ্যাশনের দিকে যাত্রার ফলে এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকতে পারে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানিতে দীর্ঘদিনের শীর্ষ অবস্থানে থাকা চীন এখন বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে। দেশটির ওপর মার্কিন প্রশাসনের ধারাবাহিক শুল্ক আরোপের কারণে ক্রয়াদেশ হ্রাস পাচ্ছে এবং এর সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিকল্প দেশগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে শুল্কনীতি আরও কঠোর করে তুলেছেন। নতুন নীতিমালায় চীনের তৈরি পোশাক পণ্যের ওপর ধাপে ধাপে সর্বোচ্চ ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। জবাবে চীনও ১২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রফতানির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে একটি সাধারণ ২ ডলারের কটন টি-শার্ট যদি চীন থেকে আমদানি করা হয়, তাহলে আমদানিকারককে ২ দশমিক ৮৩ ডলার শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে। অথচ একই পণ্য বাংলাদেশ বা ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করলে শুল্ক দিতে হচ্ছে মাত্র ০ দশমিক ৫৩ ডলার।

এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, দুই দেশের শুল্কারোপের প্রতিযোগিতা দেখে মনে হচ্ছে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা দ্রুত শেষ হবে না। উচ্চ শুল্কের কারণে চীনের ক্রয়াদেশ দ্রুত সরে আসবে। অনেক কারখানাও স্থানান্তরিত হতে পারে। বাংলাদেশকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।