ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে?

যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্কারোপ কার্যকর হওয়ার দিনই প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের রফতানি পণ্য তৃতীয় দেশে পাঠানোর জন্য দীর্ঘদিনের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। এ পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ তারা মনে করছেন যে এই সিদ্ধান্ত দেশের বাণিজ্যিক পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে এবং ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের চাপের মধ্যে থাকা ব্যবসায়ীদের জন্য আরও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। এতে বাংলাদেশকে এখন অধিকতর ব্যয়বহুল, দীর্ঘ ও অনিশ্চিত পরিবহন ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপীয় বাজারে পণ্য পাঠাতে এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রফতানিকারকদের জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

ভারতীয় স্থলবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ এতদিন কম খরচে এবং দ্রুততম সময়ে নিকটবর্তী দেশগুলোতে পণ্য পাঠাতে পারতো। বিশেষত পেট্রাপোল ও বেনাপোল সীমান্ত হয়ে ভারতের ভেতর দিয়ে স্থল ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠানো ছিল সহজতর ও সাশ্রয়ী। এখন সেই পথ বন্ধ হওয়ায় বিকল্প পরিবহন রুট, যেমন—সমুদ্রপথ বা আকাশপথে যেতে হবে, যা সময় ও খরচ—দুটোই বাড়িয়ে দেবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রফতানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলবে। তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য ও ওষুধ—এই কয়েকটি খাতে প্রতিনিয়ত দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য ডেলিভারির প্রয়োজন পড়ে। সেখানে অতিরিক্ত সময় ও খরচ রফতানিকারকদের বাজার হারানোর ঝুঁকিতে ফেলবে।

ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ

মহিউদ্দিন রুবেল আরও বলেন, "বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) সদস্যভুক্ত দেশ হিসেবে আমরা এমন পরিস্থিতি প্রত্যাশা করিনি। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত থেকে এমন সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।"

মহিউদ্দিন রুবেল মনে করেন যে এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন প্রশ্ন তৈরি করবে, বিশেষত যখন বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে কিছু উত্তেজনা বিরাজ করছে।

অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) নিয়ম অনুসারে, স্থলবেষ্টিত দেশগুলোকে অবাধ ও নিরবচ্ছিন্ন ট্রানজিট সুবিধা দিতে হয়। তবে ভারত বাংলাদেশের জন্য এই সুবিধা বাতিল করায়, বিশেষ করে ভুটান, নেপাল এবং মিয়ানমারের মতো পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থায় অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রফতানি প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যা আগামী দিনগুলোতে আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্ষতি করতে পারে।”

আঞ্চলিক বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতীয় এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি বাণিজ্যিক সমস্যা নয়, বরং আঞ্চলিক কূটনৈতিক সমীকরণেও এর প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ভারতের এই পদক্ষেপ একটি বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সংকট, যেখানে আঞ্চলিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিরোধ বাড়তে পারে।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, "ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হওয়া বাংলাদেশের রফতানি প্রবাহে কিছুটা ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে ভারতীয় গেটওয়ের মাধ্যমে প্রবাহিত পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে।" তিনি আরও বলেন, "এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বাণিজ্যিক পরিবহন ব্যবস্থায় অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে ভুটান, নেপাল এবং মিয়ানমারের মতো পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে, যেগুলো ভারতের অবকাঠামোর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।"

ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) নিয়ম অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোকে স্থলবেষ্টিত দেশগুলোর পণ্য পরিবহনের জন্য অবাধ ও নিরবচ্ছিন্ন ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। তবে ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত ভারতের মাধ্যমে ট্রান্সশিপমেন্ট খুব বেশি ব্যবহার হয়নি, তবে ভবিষ্যতে এর গুরুত্ব আরও বাড়তে পারতো।

ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের ঘোষণায় সাময়িক বড় কোনও বিপর্যয় না হলেও ভবিষ্যতের আঞ্চলিক সম্ভাবনার পথে এটি একটি বাধা তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট উদ্যোক্তা ড. রুবানা হক।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সবসময় সরাসরি জাহাজযোগে পণ্য পরিবহনকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারতের মাধ্যমে ট্রান্সশিপমেন্ট খুব একটা উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যবহার হয়নি। ফলে সরাসরি রফতানিতে তাৎক্ষণিক বড় প্রভাব পড়বে না। তবে এটি অবশ্যই আমাদের আন্তআঞ্চলিক সম্ভাবনাকে (intraregional potential) ক্ষতিগ্রস্ত করছে।”

রুবানা হকের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বিকল্প পরিবহন রুট তৈরির ক্ষেত্রে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু এই সুযোগ বন্ধ হওয়ায় ভবিষ্যতে ওইসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো কঠিন হয়ে পড়বে।

তিনি আরও বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের জন্য জরুরি হচ্ছে নিজেদের বন্দর সক্ষমতা বাড়ানো, বিকল্প রফতানি রুট খোঁজা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন কাঠামো গড়ে তোলা। এই পরিস্থিতিকে আমরা সুযোগ হিসেবেও দেখতে পারি।”

ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব: বিকল্প রফতানি রুটের প্রয়োজন

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, "ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি সংকট নয়, বরং এটি আমাদের রফতানি ব্যবস্থার বিকল্প উপায় খোঁজার সুযোগ তৈরি করতে পারে। আমাদের বন্দর সক্ষমতা বাড়ানো, বিকল্প রফতানি রুট তৈরি করা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন কাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।"

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক: আঞ্চলিক সহযোগিতা, নিজস্ব সক্ষমতা এবং কৌশলগত পরিকল্পনা

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতায় কিছুটা অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে, তবে এর মাধ্যমে নতুন কৌশল গ্রহণের সুযোগও রয়েছে। বাংলাদেশের বন্দর সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিকল্প রফতানি রুট তৈরির জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বৃহত্তর আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক রুটগুলোর দিকে নজর দিতে পারেন।

বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান ভারতের ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, "ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব পড়েছে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর।"

তৌফিকুল ইসলাম খান আরও বলেন, "এমনিতেই এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু তা ছিল না। ভারতের এই ধরনের সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক সম্পর্ক ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট সৃষ্টি করতে পারে।" "এটি শুধু বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং আঞ্চলিক কূটনীতি এবং সহযোগিতার জন্য একটি বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াবে।"

তিনি বলেন, দুই দেশ দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ভাগাভাগি করে আসছে, এবং বাণিজ্যিক প্রবাহ সুষ্ঠু রাখা উভয়ের জন্য অপরিহার্য।

তিনি উল্লেখ করেন, দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক বাজারে, উভয় দেশের জন্যই সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, যাতে একে অপরের উন্নতি এবং প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্কারোপের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো দাঁড়িয়েছে, তা মোকাবিলা করতে হলে ব্যবসায়ী ও সরকারের যৌথ উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তাদের মতে, এই সংকট উত্তরণে বিকল্প ব্যবস্থা, যেমন—চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বন্দর-পরিবহন সমন্বয় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বা আঞ্চলিক চুক্তি পুনর্গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দেশের রফতানি খাতের জন্য নতুন করে রফতানি কৌশল ও বাজার বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।