সুদ হার বেঁধে দেওয়ার সুফল পাচ্ছে অর্থনীতি

ব্যাংক ঋণে সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সুদহারের সীমা বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এ সুপারিশের পক্ষে যুক্তি হিসেবে তারা বলেছে, উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যবসার খরচ কমিয়ে আনা ও জনগণকে সুফল দিতেই সুদহার নির্দিষ্ট করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আইএমএফের আর্টিকেল ফোর-এর প্রতিনিধি দলের দেওয়া এক সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে এমন প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে আইএমএফ।

তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমানতে ও ঋণের সুদহার বেঁধে দেওয়া যৌক্তিক ছিল। এভাবে আরও কয়েক বছর চলতে দেওয়া উচিত। তিনি মনে করেন, সুদ হার বেঁধে দেওয়ার সুফল পাচ্ছে ব্যাংক ও উদ্যোক্তারা। সুদ হার বেঁধে দেওয়ার কারণে করোনার মধ্যেও ব্যাংকগুলো লাভ করতে পেরেছে। একইভাবে ঋণের হার কমে যাওয়ার কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে উৎসাহিত হয়েছে। এতে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুক্তবাজারের চেয়ে বেঁধে দেওয়া নিয়মই ভালো কাজ করছে।   

এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।  ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৫ ধারা অনুযায়ী ‘জনস্বার্থে’ ব্যাংকগুলোকে এই নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই নির্দেশনার মধ্যে ১৯৯০ সালের আগের ব্যাংক ব্যবস্থায় ফিরে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার ফলে ২০২০ সালের  এপ্রিল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি ভোক্তা ঋণ, এসএমই খাত, আবাসনসহ সব ধরনের ঋণের সুদ হার কমে আসে। ওই বছরের মাসের এপ্রিল মাসের আগ পর্যন্ত অনেক ঋণে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ কার্যকর ছিল।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যর আলোকেই কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি দেশের মানুষের স্বার্থে এমনটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, উন্নত দেশের মূল্যস্ফীতি ও আমানতের সুদহার আমাদের মতো না। এছাড়া ব্যবসায়িক খরচ কমিয়ে আনতে হলে এর বিকল্প আর কিছু ছিল না। 

যে কারণে ঋণের সুদ হার বেঁধে দেওয়া হয়:

২০২০ সালের শুরুতে ঋণের সুদ হার বেঁধে দেওয়া সার্কুলার বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখ করে, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হার দেশের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পসহ ব্যবসা ও সেবা খাতের বিকাশে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দাঁড়ায়। ব্যাংক ঋণের সুদ উচ্চমাত্রার কারণে সংশ্লিষ্ট শিল্প, ব্যবসা ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। ফলে শিল্প, ব্যবসা ও সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এতে সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতারা যথাসময়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে করতে পারেন না। এতে ব্যাংক খাতে ঋণ শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় এবং সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এমন প্রেক্ষাপটে সুদ হার বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সার্কুলারে বেশ কিছু লক্ষ্যও তুলে ধরেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে- শিল্প, ব্যবসা ও সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অধিক সক্ষমতা অর্জন, শিল্প ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা এবং কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত  জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। অবশ্য সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা ব্যবসায়ী মহলের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।

ব্যবসায়ী মহলের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের :

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআই-এর সাবেক সহ-সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, দেশে শিল্পায়নের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়েছি। তিনি উল্লেখ করেন, ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার এই সিদ্ধান্তের কারণে  অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছে।

অবশ্য ব্যবসায়ী মহলের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৪ মে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে সে নির্দেশ অনুযায়ী তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীর ঋণের সুদের হার কমাতে নানামুখী উদ্যোগ নেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এর আলোকে অর্থমন্ত্রী চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংককে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের শুরুতে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে।

তবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পৃথিবীর কোনও রাষ্ট্রেই সুদহার বেঁধে দেওয়া হয় না বলে জানিয়েছেন আইএমএফে একসময়ে অর্থনীতিবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ  ড. আহসান এইচ মানসুর। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান মানসুর বলেন, সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। বাজার বলে দেবে সুদহার কত হবে। এটি ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের ওপর ছেড়ে দেওয়া ভালো।