X
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫
১২ বৈশাখ ১৪৩২

গণমাধ্যমের সরাসরি রোগ

তুষার আবদুল্লাহ
১৪ আগস্ট ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২১, ১৫:০০

তুষার আবদুল্লাহ প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং জ্যামিতিক বিস্তারে গণমাধ্যমে অনেক ‘জীবাণু’র প্রবেশ ঘটছে। বিশেষ করে বিগত শতকের ৯০ দশক থেকে প্রযুক্তি একদিকে যেমন দ্রুত রূপ বদলাতে থাকে, তেমনি তার সবজলভ্যতাও তৈরি হয়। দাম ও জোগান, দুই দিক থেকেই। গণমাধ্যম সেই সুযোগটি গ্রহণ করে। পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশনের সম্প্রচার, উপস্থাপনা ভঙ্গিটিও বদলে যায়। ভোক্তাকে শুধু পড়িয়ে বা শুনিয়েই ধরে রাখা যাচ্ছে না। তাকে দেখাতেও হচ্ছে। তাই পত্রিকা এবং বেতারকেও দৃশ্যমাধ্যমমুখী হতে হয়েছে।

টেলিভিশনতো জন্মসূত্রেই দৃশ্যমাধ্যম। তাই বলে কি সুখে আছে বোকা-বাক্সটি? মোটেও না। তাকে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে ব্যক্তির সঙ্গে।

এই দৌড়ে টেলিভিশনকে যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির সঙ্গে দৌড়ে পেরে উঠছে না টেলিভিশন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ময়দানে ফেসবুক, ইউটিউব ব্যক্তিকে বলা যায় দৈত্যের ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। হাতে স্মার্ট ফোন সঙ্গে ইন্টারনেট ডাটা থাকলেই হলো, ব্যক্তি নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন। ওই একটি  স্মার্ট ফোনের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় শত কোটি টাকার বিনিয়োগ। ব্যক্তির সামনে ঘটতে থাকা যে কোনও ঘটনা, মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে সরাসরি। ওই জগতের নাগরিকেরা ঘটনাটির প্রতিটি মুহূর্ত দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। ঘটনাটি হয়তো এমন জায়গায় ঘটছে, সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যম উপস্থিত নেই। এমনও হতে পারে এ ধরনের ঘটনা জনসম্মুখে আনাও নৈতিকভাবে উচিত নয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের যেমন সম্পাদকীয় নিয়ম-নীতি আছে। ব্যক্তির তেমন কোনও নিয়ম-নীতি নেই। সে তার খেয়াল-খুশি মতো ঘটনাটি জনতার কাছে পৌঁছে দিলো। ব্যস, হুমড়ি খেয়ে পড়লো সবাই। সকলের হুমড়ি খাওয়া দেখে হিংসায় পুড়তে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম। ভোক্তা বা দর্শক হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এই শঙ্কায় বা লোভে তারাও নীতি-নৈতিকতা ভুলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

গণমাধ্যম বিশেষ করে দৃশ্যমাধ্যমে সরাসরি কোনও ঘটনা সম্প্রচারের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। তবে কোন ঘটনা দেখানো হবে, কতটুকু দেখানো হবে তার একটি সীমারেখা বা পরিমিতিবোধ থাকা প্রয়োজন। আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা সেই পরিমিতি বোধটুকু হারিয়ে বসে আছি। হারানোর এই ব্যর্থতার দায় নিজ কাঁধে  না রেখে তুলে দিচ্ছি ভোক্তা বা দর্শকের কাঁধে। ভোক্তার মধ্যে পরিমিতিবোধ তৈরি করার দায়িত্ব যে গণমাধ্যমের কাঁধে পড়ে এটা আমরা অস্বীকার করে যাচ্ছি। আর মুর্খের মতো বলে যাচ্ছি– ‘দর্শক খায় বলেই দেখাই’। অস্বীকার করে বসে আছি- দর্শক রুচি তৈরি করার দায়িত্বও গণমাধ্যমের।

গণমাধ্যমের নীতি এখন একটাই– সব বেচে দাও। সব বেচে দিতে গিয়ে গণমাধ্যম নীতি-নৈতিকতাও বেচে দিয়েছে। একসময় নীতি বিসর্জন দিয়েছে বিজ্ঞাপনের কাছে। এখন দিচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউবের লাইক ভিউয়ের কাছে।

সরকারের মালিকাধীন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার অভিজ্ঞতার ঠিক বিপরীত অভিজ্ঞতা বেসরকারি টেলিভিশনে। সরকারি টেলিভিশন মূলত তার প্রোপাগান্ডা প্রসারের জন্য কোনও কোনও ঘটনা  সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে। কিন্তু বেসরকারি চ্যানেল ভোক্তা বা দর্শকের চাহিদা, পছন্দকে গুরুত্ব দেয়। সেই মতো করে ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার শুরুও করেছিল। দুর্ঘটনা, রাজনৈতিক সমাবেশ, সংঘর্ষের সরাসরি সম্প্রচার দিয়ে শুরু। বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যা যত বাড়ছে, ততই সরাসরি সম্প্রচারের বিস্তার ঘটতে থাকে। এই বিস্তার প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনের তালিকায় উঠেছে বেশি। শুধু যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কথাই বলি, দেখছি অভিযানের সময় আমাদের ক্যামেরা অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজনের অন্দর মহলে ঢুকে পড়ছে।  আইন-শঙ্খলা বাহিনী বাধা দিলেও শুনছি না আমরা। হুরমুর করে ঢুকে পড়ছি। যে কোনও ব্যক্তিগত ‘আব্রু’র প্রয়োজন আছে আমরা সেই দিকটি ভাবছি না।  নিকট অতীতের ক্যাসিনো, সাম্প্রতিক সময়ে একজন নায়িকাকে ঘিরে চালানো অভিযানে আমরা একই অপেশাদারসুলভ আচরণ করে যাচ্ছি। প্রায় বিরতিহীন সম্প্রচারের দিন কয়েকবাদেই জানতে পারলাম, যার বাড়িতে অভিযান হয়েছিল,তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ  সঠিক নয় বা প্রমাণ হয়নি। তাহলে এই যে ব্যক্তির বাড়ি ঘর দেখিয়ে তাকে সমাজের সামনে উন্মোচিত করা হলো এই দায় কার? রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীদের বাড়ি অফিসে অভিযানের সময়, কিংবা কোনও কোনও সাধারণ নাগরিকের বেলাতেও একই কাণ্ড করে আসছি আমরা। 

অনেকে অজুহাত তুলতে পারে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুযোগ দিয়েছে বলেই আমরা সরাসরি সম্প্রচারের সুযোগ নিয়েছি। সুযোগ পেলেই আমরা পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিকতার কথা ভুলে যাবো?  কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইউটিউব, ফেসবুকে লাইক, শেয়ারের বন্যা বয়ে গেলে আমাকেও সেই প্লাবণে ভেসে যেতে হবে কেন?

গণমাধ্যমের এই প্রবণতায় যেমন ব্যক্তির ‘আব্রু’ রক্ষা হচ্ছে না, তেমনি গণমাধ্যম তার দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নৈতিকতার জমিন ভেঙে ভেসে গেছে ভাইরালের জলে। এ থেকে জীবন বাঁচাতে অতি সরাসরি রোগ থেকে নিজেদের মুক্ত করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৫)
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে ৯৯টি ককটেল ও ৪০টি পেট্রোল বোমা উদ্ধার
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে ৯৯টি ককটেল ও ৪০টি পেট্রোল বোমা উদ্ধার
রাস্তায় নারীদের উত্ত্যক্তের ভিডিও ভাইরাল: আরও এক যুবক গ্রেফতার
রাস্তায় নারীদের উত্ত্যক্তের ভিডিও ভাইরাল: আরও এক যুবক গ্রেফতার
নোয়াখালীতে ১০ মামলার আসামি ডাকাত সর্দার কোরবান আলী গ্রেফতার
নোয়াখালীতে ১০ মামলার আসামি ডাকাত সর্দার কোরবান আলী গ্রেফতার
সর্বশেষসর্বাধিক