ইন্টারনেট এখন সবার জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনাকালে ঘরবন্দি জীবনে বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও এখন ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে আছে। অনলাইন ক্লাস, কিছুটা পড়শোনা ছাড়া ইন্টারনেট তাদের তেমন কোনও কাজে আসে না। তা সত্ত্বেও সবার অনেক কাজ যেন ইন্টারনেটেই। বাড়ির ছোটরা তথা শিশুরা ইন্টারনেটে কী দেখছে, কী করছে এসব দেখার সময় বাবা-মায়ের নেই, বা অনেক সময় নজরদারি করা হয়েও ওঠে না। এটা শিশুদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। এজন্য বাসা-বাড়ির ইন্টারনেটে বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। এজন্য দরকার ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ বা ইন্টারনেটে বাবা-মায়েদের নিয়ন্ত্রণ। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্যারেন্টাল কন্ট্রোল শিশুর হাতে নিরাপদ ইন্টারনেট তুলে দিতে পারে, ইন্টারনেটে তাদের নিরাপদও রাখে।
ইন্টারনেটের অতি ব্যবহার শিশুদের মনোজগত বদলে দিতে পারে। মেজাজ খিটখিটে করে তুলতে পারে, আচরণ মারমুখী করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের আক্রমণাত্মক কম্পিউটার গেম শিশুর মধ্যে বিষণ্ণতার জন্ম দিতে পারে। ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি, স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত কনটেন্ট সহজলভ্য ও প্রবেশ অবাধ হলে, তা শিশুদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। শিশু কোনও ধরনের সতর্কতা ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করলে খুব সহজেই বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। বিশেষ করে পরিবারগুলোর জন্য এটি বেশ বড় একটি সমস্যা। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুখোমুখি হওয়ার হুমকি, বিভিন্ন প্রতিরোধ ব্যবস্থার কার্যকারিতা, প্রতিরোধের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ এবং হুমকিগুলোকে কীভাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায় বিবেচনায় নিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘এটা বেসিক্যালি দুই দিক থেকে হওয়ায় দরকার। এক. মোবাইল অপারেটর ও আইএসপিদের পক্ষ থেকে। তবে সচরাচর তারা উদ্যোগ গ্রহণ করে না। কোনও অভিভাবক চাইলে করে। দুই. অপরপক্ষে আছেন অভিভাবকরা। বেশিরভাগ অভিভাবকই অদক্ষ। নিজেরাই জানেন না প্যারেন্টাল কন্ট্রোল কী। তারা নিজেরা যা জানেন, তার চেয়ে তার শিশু সন্তানটি আরও বেশি জানে, তার দক্ষতাও বেশি। করোনাকালে আমরা দেখেছি ৩৫ বছরের বেশি বয়সী যারা, তাদের ইন্টারনেটভিত্তিক প্রযুক্তি জ্ঞান নেই। যে দক্ষতা দিয়ে সন্তান বা পোষ্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এজন্য বাবা-মারা তাদের মোবাইল ও ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখেন। শিক্ষকদেরও এই বিষয়ে জ্ঞান নেই। ফলে জ্ঞানহীন অবস্থায় আমাদের শিশুরা বড় হচ্ছে। এটা হতে দেওয়া যাবে না।’ তিনি মনে করেন, সন্তানদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিজের কাজে রাখতে হবে, নিয়মিত মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। ইন্টারনেটে ভালো-খারাপ দুইই আছে। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ— সেটা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তার যে বিষয়ে আগ্রহ আছে সেই বিষয়ে ইতিবাচকভাবে তাকে উৎসাহ দিতে হবে। তাহলে তার ভেতর থেকে ভালো কিছু বেরিয়ে আসবে। বাধা দিলে তার মনে কৌতূহল তৈরি হবে। সেই কৌতূহল থাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। মন্ত্রী বলেন, ‘সন্তানকে প্রযুক্তি দুনিয়ায় নিয়ন্ত্রণ ও মনিটর করতে হলে বাবা-মাকে আরও দক্ষ হতে হবে, সচেতন হতে হবে।’
জানা গেছে, গত ডিসেম্বর মাসে জারি হওয়া আইএসপি গাইডলাইনে বলা হয়েছে, ‘সব আইএসপির (ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান) প্যারেন্টাল কন্ট্রোল থাকতে হবে। কোনও অভিভাবক চাইলে তাকে এই সেবা আইএসপি অপারেটররা প্রোভাইড করবেন।’ সংশ্লিষ্টরা জানায়, প্যারেন্টাল কন্ট্রোল দু’ভাবে করা যায়, হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে। বাসা-বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার সময় আইএসপি থেকে বলা হয় আধুনিক প্রযুক্তির রাউটার কিনতে। হাল আমলের রাউটারে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল বিল্ট-ইন থাকে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট রাউটারের অ্যাপের মাধ্যমেও ইন্টারনেট সেবা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠান লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ জুনায়েদ এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সবার আগে সন্তানের বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। বাবা-মাকে বাসার ইন্টারনেট সিস্টেম পুরোপুরি মনিটর করতে হবে। এর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি, আইএসপি ও গণমাধ্যমও এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরিতে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ ব্যাপারে সোচ্চার। তিনি ২৫ হাজারের বেশি পর্নো সাইট ব্লক করেছেন, জুয়ার সাইট বন্ধ করেছেন। তিনি আসলে বড় কাজটা করে দিয়েছেন। এখন আমাদের উচিত এই জায়গাগুলোকে ফোকাস করা।’ তিনি বিটিআরসির চেয়ারম্যানের এই বিষয়ের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান।
আহমেদ জুনায়েদ মনে করেন, প্রযুক্তি শিক্ষায় এগিয়ে থেকে শিশু সন্তান যেন বাবা-মাকে নিয়ন্ত্রণ না করে, এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। ১২ বা ১৬ বছরের সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। তারা প্রযুক্তির অনেক খুঁটিনাটি জিনিস শিখে ফেলে। ফলে সে বাবা-মাকে নানা বুঝ দিয়ে ইন্টারনেটের কন্ট্রোল নিজে নিয়ে নিতে পারে, এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
অভিভাবকরা সন্তানের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করবেন যেভাবে
ইয়াং পিপল (নিউ মিডিয়া) পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ৯৫ শতাংশ বাবা-মা, যাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, কম্পিউটার সম্পর্কে উদারভাবে ভালো ধারণা পোষণ করেন, যদিও তারা নিজেদের তুলনায় তাদের সন্তাদের নিয়ে বেশি উদ্যমী। ইউকে চিলড্রেন গো অনলাইনের সমীক্ষা অনুযায়ী, বাবা-মায়েরা উন্নত প্রযুক্তির ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত অর্থাৎ ইতিবাচক মনোভাব এবং নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন।
ইউরোপিয়ান ওপিনিয়ন রিসার্চ গ্রুপ জানায়, শিশুদের ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশকিছু সফটওয়্যার আছে। ইন্টারনেট দুনিয়ায় রয়েছে টাইম লিমিটিং সফটওয়্যার, এটি বাবা-মাকে শিশুদের ইন্টারনেট বা কম্পিউটার ব্যবহারের সময় নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ফিল্টারিং অ্যান্ড ব্লকিং সফটওয়্যারটি নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবসাইট, শব্দ অথবা ছবির ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করে।আউটগোয়িং কনটেন্ট ব্লকিং সফটওয়্যারটি শিশুদের অপরিচিত ব্যক্তিদের কাছে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য যেমন- নাম, ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বর যাতে না পৌঁছায়, সেই ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ করে। কিড ওরিয়েন্টেড সার্চ ইঞ্জিন সাধারণ সার্চ ইঞ্জিনের মতোই কাজ করে। তবে বেশকিছু অতিরিক্ত সেবাও দেয়, যাতে তা অনুপযুক্ত উপাদানকে প্রতিহত করে। মনিটরিং টুল সফটওয়্যারটি শিশুরা কোন কোন সাইট ভিজিট করেছে, তার তথ্য জমা করার মাধ্যমে অভিভাবককে শিশুর অনলাইন কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়। এমনকি শিশু যদি কোনও অনুপযুক্ত ওয়েবসাইটে ভিজিট করে তবে তাদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ না করে, সরাসরি বাবা-মাকে সতর্কতা সূচক বার্তা পাঠায়। এছাড়া কনটেন্ট ফিল্টার করার মাধ্যমেও কাজটি করা যায়।