ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য যতই ঐতিহাসিক হোক, একটি বিশেষ ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সম্ভব হচ্ছে না তা সবাই জেনে গেছেন। তা হলো তিস্তার পানি ভাগাভাগি। যা গত দশ বছর ধরে দুদেশের সম্পর্কে অস্বস্তির কাঁটা হয়ে বিঁধে রয়েছে। কিন্তু অনেকেরই হয়তো জানা নেই, প্রায় চার দশক আগে এই তিস্তা নিয়েই দুদেশের মধ্যে একটি অস্থায়ী সমঝোতা হয়েছিল।
ওটাকে পুরোপুরি 'চুক্তি' বলতে হয়তো কারও কারও আপত্তি আছে। কিন্তু ঘটনা হলো ওই সমঝোতায় নির্ধারিত ফর্মুলা অনুসারেই একটি দীর্ঘ সময় তিস্তার পানি ভাগাভাগি করে এসেছিল দুই দেশ। সেই সমঝোতা যতদিন স্থায়ী ছিল, চলেওছিল মসৃণভাবে।
তারিখটা ছিল ১৯৮৩ সালের ২০ জুলাই। সেদিন ঢাকায় দুদেশের যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের পর ভারত ও বাংলাদেশ একটা 'অ্যাড-হক' বা অস্থায়ী পানি ভাগাভাগির ফর্মুলাতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। তিস্তা নিয়ে দুদেশের মধ্যে সেটাই প্রথম, আর এখনও পর্যন্ত সেই শেষবারের মতো কোনও সমঝোতা।
বৈঠকের শেষে সেই সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন দুদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী- ভারতের হয়ে রাজস্থানের প্রবীণ কংগ্রেস রাজনীতিবিদ রামনিবাস মির্ধা, আর বাংলাদেশের হয়ে এ জেড এম ওবায়দুল্লাহ খান।
ভারতের জলসম্পদমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে রামনিবাস মির্ধা তখন ছিলেন যৌথ নদী কমিশনের চেয়ারম্যান। ওবায়দুল্লাহ খান কো-চেয়ারম্যান। দুজনের কেউই অবশ্য এখন আর জীবিত নেই।
ভাগাভাগির সেই ফর্মুলায় বলা হয়েছিল, তিস্তার জলপ্রবাহের ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ আর ৩৯ শতাংশ ভারত পাবে। বাকি ২৫ শতাংশ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বয়ে যেতে দেওয়া হবে, যাতে নদীটা মরেই না-যায়।
যৌথ নদী কমিশনের আর্কাইভ থেকে পাওয়া দলিল বলছে, এই অস্থায়ী সমঝোতা টিকেছিল ১৯৮৫ সালের শেষ পর্যন্ত- অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর।
কিন্তু আজ যখন তিস্তা নিয়ে কোনও চুক্তি সই করতে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার একরকম নাজেহাল, তখন প্রায় চার দশক আগে কীভাবে সম্ভব হয়েছিল এই সমঝোতা?
তখন ঢাকার ক্ষমতায় সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, আর দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বর্ষীয়ান সাবেক কূটনীতিবিদ ইন্দর পাল খোসলা তখন ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত। তিনি এই সমঝোতার কৃতিত্ব দিচ্ছেন দুদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাজনৈতিক আগ্রহকেই।
ইন্দরপাল খোসলা বলছিলেন, ‘এরশাদ সাহেব তিস্তা নিয়ে একটা ডিল করতে খুব আগ্রহী ছিলেন। কারণ এটা তার নিজের অঞ্চল রংপুরের জন্য লাভ বয়ে আনবে, এটা তিনি জানতেন। উৎসাহ ছিল ম্যাডাম ইন্দিরা গান্ধীরও। দুজনেই অর্ধেক রাস্তা এগিয়েছিলেন বলে মাঝামাঝি একটা পয়েন্টে আমরা মিলতে পেরেছিলাম।’
‘তা ছাড়া সে সময় আঞ্চলিক রাজনীতির বাস্তবতাও প্রক্রিয়াটাকে ত্বরাণ্বিত করেছিল। এরশাদ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে চাইছিলেন, সেটাও অবশ্যই প্রভাব ফেলেছিল।’
সবচেয়ে বড় কথা, সে সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তিস্তা নিয়ে দুদেশের আলোচনায় কোনও ছায়া ফেলেনি বলেই ’৮৩ সালের সমঝোতা অনেক সহজে করা গিয়েছিল। তা স্বীকার করতেও দ্বিধা নেই ইন্দর পাল খোসলার।
বাংলাদেশের জাতীয় পার্টির প্রবীণ এমপি ও এরশাদের জমানায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কথায়, ‘আসলে জিনিসটা হলো, তখন এটা করার জন্য একটা রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল, রাজনৈতিক পরিবেশও ছিল।’
‘সমঝোতায় আরও বলা হয়েছিল, অ্যাড-হক ভিত্তিতে এটা চালু হোক। পরে আরও ভালো করে স্টাডি করে চূড়ান্ত চুক্তিও করা হবে’, বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন তিনি।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পরে বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রীর দায়িত্বও সামলেছেন। তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে এখন বাধাগুলো কোথায় সেটা তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন।
‘তা ছাড়া সেই ’৮৩ সালে তখন ভারতের দিক থেকেও একটা সমঝোতা করার গরজ ছিল। কারণ তখন তারা তাদের দিকে তিস্তার ওপর একটা ব্যারাজ নির্মাণের কাজ করছিল’, বলছিলেন তিনি।
ভারতের গাজলডোবায় সেই তিস্তার ওপর ব্যারাজ ও লিংক ক্যানাল নিয়ে পরে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু সম্ভবত তখন সেই নির্মীয়মাণ প্রকল্পটি অস্থায়ী হলেও একটি সমঝোতার পথ প্রশস্ত করেছিল। অর্থাৎ গাজলডোবা তৈরি হলেও তিস্তার প্রাপ্য পানির ভাগ পেতে বাংলাদেশের সমস্যা হবে না, ভারতের দিক থেকে এটা প্রমাণ করার তাগিদ ছিল।
ইন্দর পাল খোসলা যেমন বলছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সে সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বলেই ওই সমঝোতা সম্ভব হয়েছিল-একই প্রতিধ্বনি শোনা গেল আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কণ্ঠেও।
তিনি বলছিলেন, ‘তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। উনি বাংলাদেশের ব্যাপারে অনেক বেশি অ্যাকোমোডেটিভ ছিলেন। জ্যোতি বসুর কারণেই পরে ’৯৬ সালে গঙ্গাচুক্তি সম্ভব হয়েছিল, এটা আমরা সবাই জানি। তিস্তার সমঝোতার ব্যাপারেও তার সায় ছিল।’
"কিন্তু এখন তিস্তা নিয়ে আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গ যেভাবে 'ফ্যাক্টর' হয়ে উঠেছে, ওই রাজ্যে আমরা যে ধরনের আচরণ লক্ষ্য করছি তাতে গোটা প্রক্রিয়াটাই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে’, মন্তব্য তার।
বাংলাদেশের সুপরিচিত পানিসম্পদ ও নদী বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত আবার মনে করেন, '৮৩ সালের সেই সমঝোতাকে চুক্তি বলা ঠিক হবে না।
তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘৩৬-৩৯-২৫-এর ফর্মুলাটা যৌথ নদী কমিশনের সভায় গৃহীত হয়েছিল ঠিকই, সেটা তাদের মিনিটস বা কার্যবিবরণীতেও আছে। তবে এ ব্যাপারে কোনও দলিল কিন্তু তৈরি হয়নি। চুক্তি, অর্থাৎ এগ্রিমেন্ট বা ট্রিটি তো অনেক দূরের কথা!’
‘কিন্তু একটা কথা সেই সমঝোতায় ছিল যে, তিস্তায় পানির পরিমাণ দুই দেশের চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। বলা হয়েছিল সেই প্রবাহ বাড়ানোর কাজটাও করতে হবে।’
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনও অগ্রগতি হয়নি। আর তিস্তার ব্যাপারে ঐকমত্য বা পূর্ণাঙ্গ চুক্তির সম্পাদন আজও অধরা থেকে যাওয়ার সেটা একটা বড় কারণ বলেই ড. নিশাতের ধারণা।
ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বীনা সিক্রি আবার মনে করেন, তিস্তায় জলের প্রবাহ নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবও চুক্তি সম্পাদনকে কঠিন করে তুলেছে। তিনি জানাচ্ছেন, ‘তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে পানির পরিমাণ নিয়ে তেমন নির্ভরযোগ্য বা পুরনো রেকর্ড নেই।
‘গঙ্গার ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা ছিল না। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে গঙ্গায় জলপ্রবাহের সব ডেটা আছে। ফলে গঙ্গা চুক্তির ক্ষেত্রে সেটা সাহায্যও করেছিল। কিন্তু তিস্তায় সেটা নেই বলেই আমরা কখনও জলের সঠিক পরিমাণ নিয়ে কথা বলতে পারি না। শতকরার হিসেবে বলতে হয়। তাতেই সমঝোতা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়’, বলছেন তিনি।
তিরাশি সালের যে সমঝোতায় বাংলাদেশ ও ভারত যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৯ ভাগ পানির হিস্যায় রাজি হয়েছিল, আগামী দিনে কোনও তিস্তা চুক্তি হলে সেই একই ফর্মুলা বহাল থাকবে- এমন সম্ভাবনা অবশ্য ক্ষীণ।
বরং ২০১১ সালে যে চুক্তির খসড়ায় দুই দেশ রাজি হয়েছিল (কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাধায় যা সম্পাদিত হতে পারেনি) তাতে পানির সমান ভাগাভাগির সূত্রই মান্যতা পেয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রের ইঙ্গিত।