X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গেরিলা

সাকিলা জেসমিন
০৮ মার্চ ২০২১, ১৩:০১আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২১, ১৪:১৬

সাকিলা জেসমিন
নারী দিবস এলেই নানা রকম কথাবার্তা হয়। নিজেকে কেমন জানি তখন কেবল ‘নারী নারী’ মনে হতে থাকে। ইদানীং  একটু বেশিই এমনটা হয়। সত্যি বলতে কী, আমি ছোটবেলা থেকে এমনটা দেখিনি। এই দিবসকে ঘিরে এখন যতটা মাতামাতি, তখন কিন্তু এমন ছিল না। ভালো লাগতো যদি এই মাতামাতির পর সমাজে ভালো কিছু পরিবর্তন আসতো। মেয়েদের জন্য ভালো কিছু আসা আসলেই কঠিন।

অনেক বৈষম্যের মধ্যে একটি মেয়েকে তার পথ চলতে হয়। অনেক কষ্টের এই পথ চলতে গিয়ে কোনও মেয়ে যদি অধিকার সচেতন হয় তাহলেই শেষ, সে তখন সবার চরম শত্রু হয়ে যায়। ছেলেদের কথা বাদই দিলাম, এই সমাজে মেয়েরাও মেয়েদের কম শত্রু নয়। ভালো করে চারদিকে একটু তাকালে, খুব সহজেই, বেশি দূরেও যেতে হবে না, এমনকি পরিবারের মধ্যেই নানা উদাহরণ সৃষ্টি হওয়ার মতো ঘটনা কম ঘটে না।

শাশুড়ি-বউর মধ্যে যে টানাপড়েন তা তো চিরায়ত কালের। এত যে নারী দিবস হলো, ক’জন শাশুড়ি পরিবর্তন হয়েছেন, বউকে নিজের মেয়ে করতে পেরেছেন। ক’জন বউই বা শাশুড়িকে মায়ের মতো আপন করতে পেরেছেন। আবার এই দুই নারীর মাঝখানে এসে স্বামী অথবা শ্বশুরের নেতিবাচক ভূমিকার চেয়ে ঢের বেশি ঘি ঢালেন যারা তারা কিন্তু মেয়েই। আমিন খান আর নিপুণ অভিনীত ‘মা বড় না বউ বড়’ সিনেমা এমনই হয়ে যায়নি। এই নামের নাটকও ইউটিউবে অনেক ভিউ।

একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকার কারণে সম্প্রতি মেয়েদের গায়ের রঙ নিয়ে কথা উঠেছে। আমরা যতই আধুনিকতার কথা বলি না কেন, একটা কালো মেয়েই জানে গায়ের রঙের জন্য পদে পদে কত হীনম্মন্যতা তাকে পোহাতে হয়। কীভাবে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে সে কালো। ফর্সা টুকটুকে একটা বউ আনার শখ ছেলের মায়েরই বেশি থাকে। ছেলে যদিও বা কোনও কালো মেয়েকে পছন্দ করে ফেলে, তারপর থেকে কত ধরনের ‘বাঁশ’ ওই মেয়েকে খেতে হয় আর জীবনটা ফাটা বাঁশে পড়ে কতটা ত্রাহি ত্রাহি করে সেই মেয়েই বলতে পারে। তাই আমি মনে করি রঙ নিয়ে কথা বলা মন্দের ভালো হয়েছে। এই সুযোগে সমাজে যদি কিছু ভালো পরিবর্তন আসে সেই বা মন্দ কী?

অনেক মুরুব্বি শ্রেণির নারীর মুখে বলতে শুনেছি, পুরুষের চরিত্র একটু আধটু খারাপ হতেই পারে। এটা জেনেই আমরা সংসার করেছি। তিনি যে এভাবে নিজের ছেলে আর মেয়ে সন্তানের মধ্যেও বিস্তর ফারাক করে ফেলেন সেই গল্পও কম জানা নেই।

কিন্তু আমার কথার আঙ্গিকটি একটু ভিন্ন। কোন মনস্তাত্ত্বিক কারণে পুরুষটি বিবাহিত জেনেও তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে একটি মেয়ে এই কথা আমি কিছুতেই বুঝি না। মেয়েটি কি জেনে-শুনে আরেকটি মেয়ের ক্ষতি করছে না? কেবল নিজের স্বার্থ চিন্তা করে একটি মেয়ে আরেকটি মেয়ের জীবনে কীভাবে আঁধার নিয়ে আসে?

আমার কথাগুলো মেয়ে হয়েও মেয়েদের সমালোচনা অর্থাৎ আত্মসমালোচনার মতো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী করবো, আমার মনে এসব প্রশ্ন সব সময় ঘুরপাক খায়। বড় হওয়ার পর থেকে স্বজাতির মধ্যে এমন বিরোধ আমার মনে দাগ কাটে। পারিপার্শ্বিকতা আমাকে ব্যথিত করে।

মেয়ের মনে শৈশবেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে তারা শুধু ঘরের কাজ করবে, আর বাইরে ছেলেরা। কিন্তু অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ঘরের ভেতর রেখে, অর্থাৎ পেছনে ফেলে রেখে দেশ তো আগাতে পারে না। তাই কী হলো, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন এলো সমাজে, মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করা হলো ঘরের বাইরে যেতে, অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হতে। এতে মেয়েদের বাইরে যাওয়া অর্থাৎ কাজ করার সংখ্যা বাড়লো ঠিকই। কিন্তু তাদের ঘরের কাজের দায়িত্ব কিন্তু কেউ নিলো না। মাঝখান থেকে কাজের বোঝা দ্বিগুণ হলো। তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই তা বলছি না।

আবার এমনও হয়, স্বামী যদি বউকে ঘরের কাজে সাহায্য করে তাহলে সেই বউকে পদে পদে কথা শুনতে হয় শাশুড়ি আর ননদের কাছ থেকে। আহারে ছেলেটা আমার গেলো, বউ কি জাদু করেছে? আমার ভাই একবারে ভেড়া হয়ে গেছে, এসব কথা শুনতে হয় না এমন ঘটনা বিরল। এমনকি পাশের বাসার গৃহিণী ভাবিরাও নানাভাবে এর সমালোচনা করতে ছাড়েন না। কেউ কেউ এও বলেন, পুরুষ মানুষ কেন পাকঘরে যাবে? ছিঃ! স্বামীকে কীভাবে বশ করে রেখেছে।

আবার মেয়েকে তো বটেই, মেয়ের মাকেও ছাড়ে না কখনও কখনও। যেমন মেয়েকে কেন বিয়ে দিচ্ছেন না, বয়স হয়ে গেলে তো কেউ বিয়ে করবে না, মেয়ের কি প্রেম আছে? ছ্যাঁকা খেয়েছে? এমনি কতশত ব্যক্তিগত প্রশ্নের মুখে যে পড়তে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে প্রশ্নগুলো যিনি করেন তিনি যে নিজেও একজন নারী এটা বোধহয় মনে থাকে না। আবার মেয়ে বিয়ে দিয়ে ফেললেও রক্ষা নেই। লোভে পড়ে বাচ্চা মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে বলেও ফেলেন অনায়াসে।

এই সমাজে কোনও মহিলা যদি ডিভোর্স দেন তাহলে তো ‘কবিরা গুনাহ’ করেছেন। মহিলারাই কিন্তু তখন বলবে, আমরা কি স্বামীর ঘর করি না। পুরুষের চোখ তো একটু এদিক সেদিক যেতেই পারে। এজন্য কি ডিভোর্স দিতে হবে। নিশ্চয়ই মহিলার চরিত্র খারাপ। এমন কথা বলতেও ছাড়বে না। তারপর আবার যদি কোনও ডিভোর্সি মহিলা কাউকে পছন্দ করে আবার বিয়ে করার কথা চিন্তা করে তাহলেও তো তার সামনে বাঁকা কথার পাহাড় জমতে থাকে।

অফিসে প্রমোশন পেয়েছেন তো মেয়ে কলিগরাই আপনার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লেগে যাবে। নিশ্চয়ই বসের সাথে লাইন। আমরা তো পারি না বসের সাথে রং-ঢং করতে, এজন্য আমাদের কোনও উন্নতি নাই। অথচ অন্য মেয়ের পেছনে না লেগে নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর দিকে মন দিলে হয়তো ওই মেয়ে অনেক এগিয়ে যেত পারতো। কিন্তু তা না করে আরেকটি মেয়েকে পেছনে টেনে ধরা বোধকরি অনেক সহজ?

অনেক বছর পর আমার খালাত বোনের সাথে দেখা, যার স্বামী মারা গেছে কিছু দিন হলো। শুনেছি স্বামী মারা যাওয়ার পর তাকে বাড়ি থেকে বের করার জন্য শাশুড়ি উঠেপড়ে লেগেছেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে বললেন, মেয়েদের আবার থাকা না থাকা। বিয়ের পর প্রথম মেয়ে হওয়ায় সবার মুখ কালো, আবারও মেয়ে হলো। ছেলে না থাকায় সারা জীবন শ্বশুরবাড়িতে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। স্বামীর পেনশনের টাকা থেকেও বঞ্চিত করার জন্য শাশুড়ি বহু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এখন। এরমধ্যে যুদ্ধ করে মেয়ে দুটোকে নিয়ে কীভাবে আছেন তা এক ইতিহাস।

২০০৭ সালে আমেরিকার ওকলাহোমা ইউনিভার্সটিতে নারীর ক্ষমতায়নের ওপর একটা কোর্স করেছিলাম। মনে আছে, ক্যাথরিন জেকসন হোয়াইট নামের আমেরিকান শিক্ষক ক্লাসে আমাদের বলেছিলেন, নারীদের এগিয়ে যেতে হলে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে। আমি তো অবাক এটা আবার কী বলে? তিনি তখন বুঝিয়ে বললেন, গেরিলারা যেমন গোপনে একজনের সঙ্গে অন্যজনের যোগাযোগ রেখে এগিয়ে যায়, বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় থাকে না, তেমনি গোপনে একজন নারীকে আরেকজন নারীর হাতে হাত রেখে গিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, বৈরিতা করে এগুনো যায় না। 

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে: জাতিসংঘ
গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে: জাতিসংঘ
তীব্র তাপে গলছে শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের কার্পেটিং
তীব্র তাপে গলছে শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের কার্পেটিং
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার দাবি ডিআরইউর
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার দাবি ডিআরইউর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ