X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগ-বিএনপি আর মিয়ানমার-মালদ্বীপের কথা

ডা. জাহেদ উর রহমান
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:৫২আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:৫২

ডা. জাহেদ উর রহমান সব সময় ক্ষমতাসীনদের কাছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ‘বাজে’ একটা প্রতিষ্ঠান। যদিও বিরোধীদের কাছে উল্টো। বিরোধীরা এই সংস্থার ‘সূচক’নামের অস্ত্রটি ব্যবহার করে সরকারকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা এই সংস্থার রিপোর্টের পেছনে ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজে পেয়েছিল। ঠিক একইভাবে বর্তমান সরকারও ব্যতিক্রম নয়।

যাক, সেসব কথা, আসুন আমরা একটু তলিয়ে দেখি প্রকৃত অবস্থাটি কী। এখন দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে মোট স্কোর ১০০-তে করা হয়। আগে তেমনটা ছিল না। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শূন্য থেকে ১০ স্কেলে স্কোর নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই স্কেলে ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার এক নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। পাঁচ বছরে বাংলাদেশের স্কোর ছিল যথাক্রমে ০.৪, ১.২, ১.৩, ১.৫ ও ১.৭। এই ৫ বছর দুর্নীতির তালিকার সর্বশেষে থাকার ‘সুনাম’ সব সময় বিএনপিকে দেওয়া হয়, কিন্তু এটা পুরোটা সঠিক নয়। প্রথম বছরটি আসলে আওয়ামী লীগের শেষ বছরের আমলনামা ছিল।

বাংলাদেশ প্রথম দুর্নীতির তালিকায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থানটিতে যায় ২০০১ সালে।‌ ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনটি হয়েছিল বছরের শেষের দিকে, অক্টোবর মাসে। ওই বছরের প্রায় পুরোটা সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তাই বাংলাদেশের এই আমলনামার পেছনে প্রধান ভূমিকা আওয়ামী লীগের। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটা বিএনপির ঘাড়ে কেন এলো? আসলে এই বছর, ২০২১ সালে যেমন প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালের রিপোর্ট, তেমনি ২০০১ সালের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ২০০২ সালে। তখন বিএনপি মাত্র ক্ষমতায় এসেছে, তাই ফলাফলটা এসে পড়েছিল তার ঘাড়ে।

বাংলাদেশ প্রথমবার (২০০১ সালে) স্কোর করেছিল ০.৪। ২০০২ সালে অর্থাৎ বিএনপির প্রথম বছর সেই স্কোর চলে যায় ১.২-এ। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ স্কোর করে বাংলাদেশ। এর মানে ২০০১-এর তুলনায় ২০০২-এ বাংলাদেশের দুর্নীতির পরিমাণ অনেক কম ছিল। এরপর ধীরে ধীরে হলেও ক্রমাগত স্কোর বেড়েছে- ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫-এ যথাক্রমে ১.৩, ১.৫ ও ১.৭। কিন্তু অন্য দেশগুলোর দুর্নীতি আমাদের চাইতে কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশে সর্বনিম্ন অবস্থানেই রয়ে গেছে।

প্রশ্ন আসতে পারে, ২০০০ বা তার আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের অবস্থান কী ছিল? দুর্নীতির এই সূচক চালু হয় ১৯৯৫ সালে, কিন্তু বাংলাদেশকে প্রথমবার এই সূচকে বিবেচনা করা হয় ২০০১ সালে। ফলে এর আগে কোনও তথ্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নেই। ‌থাকলে হয়তো সেটা আওয়ামী লীগকে বিব্রত করার মতো তথ্য হতেও পারতো।

এখানে এটা নিশ্চিত করছি,‌‌ বিএনপি’র দুর্নীতির সাফাই আমি গাইতে আসিনি। বিএনপির সময় পরপর চারবার দুর্নীতির সূচকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানটিতে থাকা নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্য ভীষণ লজ্জার। এর মাশুল বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দিচ্ছে, দেবে ভবিষ্যতেও।

এই বছর বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে থেকে ১২তম হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ১৪তম। অর্থাৎ এই এক বছরে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনমন হয়েছে। তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর স্কোর বলে এই সময়ে বাংলাদেশে দুর্নীতি বাড়েনি। এই বছর বাংলাদেশ স্কোর ২৬। গত বছর এবং তার আগের বছরও একই স্কোর ছিল। ‌অর্থাৎ এই সূচক অনুসারে এই তিন বছর বাংলাদেশের দুর্নীতির প্রকোপ মোটামুটি এক‌ই ছিল।

এই বছর একই স্কোর করেও বাংলাদেশের অবস্থানের অবনমন হয়েছে, এর মানে হলো- কোনও কোনও দেশ বাংলাদেশের চেয়ে ভালো স্কোর করেছে অর্থাৎ দুর্নীতি রোধে‌ তাদের উন্নয়ন হয়েছে।

দুই সময়ের দুই রকম স্কোরিং সিস্টেম ছিল বলে সরাসরি তুলনা হয়তো করা যায় না, কিন্তু আমরা একটু যদি দেখি তাহলেও সেখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাওয়া সম্ভব। এই বছর দুর্নীতির তালিকার সবচেয়ে খারাপ অবস্থানটি হচ্ছে সোমালিয়ার। যারা ১০০ পয়েন্টে ১২ পেয়েছে। এই স্কোরকে আমরা যদি ১০-এর স্কেলে কনভার্ট করি তাহলে সেটা হয় ১.২। অর্থাৎ এই সর্বনিম্ন স্কোর বাংলাদেশের প্রথম বারের (২০০১) সর্বনিম্ন স্কোরের তিনগুণ।

এবার দুর্নীতির সূচকে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মাত্র তিন‌টি দেশ, উত্তর কোরিয়া, কম্বোডিয়া এবং আফগানিস্তান আমাদের পেছনে আছে, অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আফগানিস্তান আমাদের পেছনে। আফগানিস্তান দেশটিকে নিয়ে দুর্নীতির ব্যাপারে আমাদের অন্তত হাসাহাসি করা উচিত হবে না। এই বছরের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে আফগানিস্তানকে বরং প্রশংসা করা হয়েছে এই বলে– দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আছে। ২০১২ সালে তাদের স্কোর ছিল ৮, যা ১১ পয়েন্ট বেড়ে ২০২০-এ হয় ১৯। হ্যাঁ, স্কোরের গতি প্রকৃতি বলছে দেশটি আমাদের ছাড়িয়ে যাবে অচিরেই।

একই কথা প্রযোজ্য মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও। সরাসরি কিংবা মুখোশ পরা সামরিক শাসনের অধীনে থাকা মিয়ানমারও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ধীরে ধীরে উন্নতি করছে। ২০১২ সালে তাদের স্কোর ১৫ ছিল, যা ১৩ পয়েন্ট বেড়ে এই বছর ২৮ হয়ে ছাড়িয়ে গেছে আমাদের। এই দেশটির উন্নতির কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল।

‘জিরো টলারেন্স’ ইদানীং এই দেশে খুব উচ্চারিত শব্দ যুগল। জনগণের জন্য খারাপ যেকোন‌ও বিষয় প্রসঙ্গে সরকারি দলের পক্ষ থেকে উচ্চারণ করা হয়– হোক সেটা মাদক কিংবা দুর্নীতি। জিরো টলারেন্স দূরে থাকুক দুর্নীতি দমন কিংবা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আমাদের যদি সামান্যতম সদিচ্ছাও থাকতো তাহলে আমরা একই জায়গায় ঘুরপাক খেতাম না।

এবার আসা যাক মালদ্বীপের প্রসঙ্গে। এই বছরের সূচকে দেশটি ম্যাজিক দেখিয়েছে, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে তারা। গত বছরের তুলনায় এক বছরে এই দেশটি ১৪ পয়েন্ট বেশি পেয়েছে, যাতে তার অবস্থানের উন্নতি হয়েছে ৫৫ ধাপ (১৩০ থেকে ৭৫)। দেশটি প্রমাণ করেছে দুর্নীতি দমনকে কেউ যদি স্রেফ কথার কথা হিসাবে না বলে কিছুটা সিরিয়াসলি নেয়, তাহলে আসলে খুব দ্রুত উন্নতি করা সম্ভব।

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কী করলে সফল হওয়া যেতে পারে, সেটা বোঝার জন্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তার এই বছরের রিপোর্টে আফগানিস্তান, মিয়ানমার এবং মালদ্বীপের দুর্নীতি দমনে উন্নতির ক্ষেত্রে দেশভেদে নানা রকম কারণ উল্লেখ করেছে। আসুন, সবগুলো একসাথে জেনে নেওয়া যাক।

আলোচিত তিনটি দেশের কেউ দুর্নীতি দমনে আইন সংশোধন করেছে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধন এবং প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতায়িত করেছে। কেউ নতুন দুর্নীতি দমন কমিশন করেছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে– গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী করা, নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করা, সর্বোপরি দুর্নীতির দায়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় এনে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের দৃঢ় সদিচ্ছা জনগণের সামনে প্রদর্শন করা।

অনেকে নিশ্চয়ই ভাবছেন এগুলো তো পুরনো কথা, জানি আমরা সবাই।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ