X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বদলে যাক দেখার চোখ

তুষার আবদুল্লাহ
২৩ জানুয়ারি ২০২১, ১৩:৩৩আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২১, ১৩:৩৮

তুষার আবদুল্লাহ আমার এক অগ্রজ বন্ধুর মেয়ে বিলেত ফেরত। আইন নিয়ে পড়েছে সেখানে। এখানে একটি মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বাবা’র কাছে আবদার করেছিল, আমার সঙ্গে বৈঠকের। বসার পর দেখলাম গণমাধ্যম নিয়ে ওর অভিযোগ বিস্তর। শুধু অভিযোগই নয়, উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা-হতাশাও রয়েছে। গণ্যমাধ্যম নারীকে যে চোখে দেখে, বিশেষ করে নারী নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর, নারীকে উপস্থাপন নিয়ে ওর আপত্তি। বন্ধু কন্যার আপত্তি যে যে ক্ষেত্রে, তার সঙ্গে আমার, আমাদের আপত্তিগুলোও মিলে যায়। আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি, তারাও এ বিষয়গুলো নিয়ে অস্বস্তিতে থাকি। নির্যাতনের শিকার নারীর পরিচয় গোপন রাখার যে নৈতিক অবস্থান, সেখানেও আমরা দৃঢ় হতে পারিনি। নড়বড়ে ভীষণ। দুই একটি গণমাধ্যম নির্যাতনের শিকার নারীর নামটি হয়তো বলছে না, কিন্তু তার চারপাশের সকল কিছু এমনভাবে উপস্থাপন করছে যে, মেয়েটিকে শনাক্ত করা সহজ গণিতে রূপ নেয়। একইভাবে ঘটনার বর্ণনা নিয়েও আমাদের গণমাধ্যম কর্মীদেরই প্রবল আপত্তি রয়েছে।

তারপরও এমন কাণ্ড কেন ঘটছে? বন্ধু কন্যাকে বললাম, আমরা যারা গণমাধ্যম পরিচালনা করি, খবরের প্রহরী, তাদের বড় একটি অংশ ‘গণমাধ্যম নিরক্ষর’। সমাজ ও নৈতিক স্পর্শকাতরতা নেই আমাদের। পাশাপাশি নারীকে দেখার চোখটিও আমাদের বাঁকা। ফলে এ ধরনের খবর পরিবেশনে এক প্রকার প্রচ্ছন্ন প্রতিহিংসা ও বিনোদন উপভোগ করি। সেই সঙ্গে খবর  বিক্রি করতে মশল্লা মাখিয়ে নিতেও আমরা ভুল করি না। ফলে আমাদের পরিবেশিত খবরে নারীকে আরেক দফা হেনস্তা বা অপমানই করা হয়। প্রসঙ্গ হিসেবে নোয়াখালী, কলাবাগান ও ঢাকার কুর্মিটোলায় নারীর যৌন নিপীড়নের ঘটনাটি চলে আসে। বন্ধু কন্যার প্রশ্ন ছিল, কেন নারীকেই দায়ী করা হয়, তার উপর দায় চাপানো হয়? বললাম- সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্বকে নারী চোখে দেখার শ্লোগানটি এখনও পোস্টার হয়েই আছে, এখনও পুরুষের আধিপত্যবাদ থেকে নারীর মুক্তি ঘটেনি। তবে সকল মুক্তি ও স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থের যোগ আছে। নারীরা আর্থিক স্বচ্ছলতার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াতেও পুরুষের সঙ্গে তার বিরোধ হবে। কারণ পুরুষ নারীর স্বনির্ভরতা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি সাময়িক। শেষ পর্যন্ত পুরুষ আর আধিপত্যের সাম্রাজ্য
ধরে রাখতে পারবে না।

বন্ধু কন্যা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠনের সঙ্গে ওর এরই মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে। সমবয়সী বন্ধুরা এক জোট হবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওর প্রশ্ন ছিল, এতো সংগঠন কাজ করার পরেও কেন, নারীকে দেখার চোখ বদলালো না, কেন নারীর কাঁধেই আগে দোষ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে? গণমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে গত তিন দশকে অনেক নারী সংগঠন ও তাদের নেতাদের আমার কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করেছে, করছে অনেক বেসরকারি সাহায্য সংস্থা। সেই কাজগুলো প্রকল্প নির্ভর। প্রকল্পের বরাদ্দ শেষ তো, অধিকারের শ্লোগানও শেষ। এছাড়া এসব সংগঠনের ভেতরেও নারীর চাপা ক্ষোভ ও কান্না রয়েছে। কারণ সেখানে নারী সহকর্মী ও সাহায্য প্রত্যাশীদের নিগৃহীত হবার অভিযোগ আছে। নারী সংগঠন করতে এসেছিলেন যারা, তারা সভা সমিতি, সেমিনার করে বেড়িয়েছেন। কতিপয় নির্যাতিতাকে প্রদর্শিত করে ব্যক্তিগত ও সংগঠনের ফসল ঘরে তুলেছেন। নেতৃত্বে থাকা মানুষগুলো সমাজের এমন স্তর থেকে এসেছেন, যাদের সঙ্গে আম নারীদের যোজন যোজন দূরত্ব। এই দূরত্ব তারা কমিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই সঙ্গে আছে তাদের রাজনৈতিক আত্মীয়তা। এসবের যোগফলে সংগঠনগুলো আপনশক্তি হারিয়ে আর পুর্বের মতো করেও নিপীড়িত নারীর পাশে দাঁড়াতে পারছে না।

কিন্তু তাই বলে কি আমার বন্ধু কন্যা থেমে যাবে? আড্ডায় আমার কন্যাও উপস্থিত ছিল। দুই কন্যারই চোখ আমার দিকে। আমি বললাম, থেমে যাওয়া যাবে না। শুরু করতে হবে। তবে যেভাবেই শুরু করো না কেন, কাজের প্রতি সততা থাকতে হবে। কাজটি কেবল যেন প্রদর্শনের জন্য না হয়। তরুণদের নেমে আসতে হবে। হাতে হাত রেখে ছেলেতে মেয়েতে এক সঙ্গে। আমাদের  চালসে চোখের অস্ত্রপচার দরকার। চোখের জ্যোতি ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু হোক। কবে শেষ হবে, কবে পরিবর্তন আসবে সেই অপেক্ষা কিংবা উৎকণ্ঠায় থাকাটাই সময়ের অপচয়। মশালের হাত বদল হবে। একদিন ঠিক আমরা আবার আলো জ্বালাবো  অন্ধকারে নিমজ্জিত বাতিঘরে। সেই লক্ষ্যে মাঠে নামুক আমার কন্যারা।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ