X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুধপানে কোভিড-১৯ জয়, বাহুল্য নাকি বাস্তবতা?

ড. এ কে এম এম হুমায়ুন কবির
১৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৪২আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৪২

ড. এ কে এম এম হুমায়ুন কবির কোভিড-১৯ বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। SARS-CoV-2  (Severe Acute Respiratory Syndrome-related coronavirus 2)  নামের ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট রোগটি, সময়ের পরিক্রমায় মহামারিতে রুপান্তরিত হয়েছে। এই প্রলয়ঙ্করী মহামারি ইতোমধ্যে কেড়ে নিয়েছে প্রায় ১৯ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ। দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। মানবসভ্যতার এমন ক্রান্তিকালে, সারা বিশ্বের গবেষকবৃন্দ সমন্বিত ও স্বাধীনভাবে এই রোগের প্রতিষেধক এবং কার্যকর ওষুধ উদ্ভাবনে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনই এক পরিস্থিতিতে, কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে সক্ষম এমন এক প্রাকৃতিক উপাদান খুঁজে পেয়েছে একদল গবেষক; যা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত গবেষণায় ভিন্নমাত্রা যোগ করতে পারে।        

সম্প্রতি, স্পেনের গবেষক দলটি দাবি করেছেন, ল্যাকটোফেরিন (দুধে বিদ্যমান এক ধরনের প্রোটিন) কোভিড-১৯ প্রতিকার ও নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। International Journal of Research in Health Sciences (Volume 8, Issue 1, 2020)-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে গবেষক দলটি উল্লেখ করেছেন, তারা ৭৫ জন বিভিন্ন বয়সী কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী ও তাদের সংস্পর্শে আসা ২৫৬ জন ব্যক্তির ওপর পরীক্ষাটি চালিয়েছেন। গবেষক দলটি কোভিড-১৯ আক্রান্তদের শরীরে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় এবং রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের এর অর্ধেক মাত্রায় ১০ দিন ল্যাকটোফেরিন সাপ্লিমেন্ট প্রয়োগ করে এক মাস যাবৎ পর্যবেক্ষণ করেছেন।    

গবেষক দলটির ভাষ্যমতে, ল্যাকটোফেরিন প্রয়োগ করার ফলে বেশিরভাগ রোগীর জ্বর, মাথাব্যথা, শুষ্ক কাশি ও হালকা শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ ৩-৫ দিনে যথেষ্ট পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে এবং এক মাসের মধ্যে সবাই সুস্থ হয়েছেন। এমনকি, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসা ২৫৬ জন ব্যক্তির (যাদের অর্ধেক মাত্রায় ল্যাকটোফেরিন প্রয়োগ করা হয়েছিল) মধ্যে কারোরই এই এক মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়নি।      

ল্যাকটোফেরিন কী?

ল্যাকটোফেরিন হলো এক ধরনের গ্লাইকোপ্রোটিন (আয়রনবন্ধন প্রোটিন), যা ট্রান্সফেরিন প্রোটিন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং শরীরের আয়রন বা লৌহের সঙ্গে বন্ধন গঠনে সক্ষম। আমাদের শরীরের বিভিন্ন কোষ ও গ্রন্থিতে এই ল্যাকটোফেরিন তৈরি হলেও, বাহ্যিকভাবে এই প্রোটিনের প্রধান উৎস হলো দুধ। আমরা গরুর দুধ পানে অভ্যস্ত হলেও গরুর দুধের চেয়ে মায়ের বুকের দুধ ও উটের দুধে তুলনামূলক বেশি ল্যাকটোফেরিন পাওয়া যায়। ল্যাকটোফেরিন আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ল্যাকটোফেরিন মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শরীরের প্রদাহজনিত সমস্যা কমায় এবং বিভিন্ন  জীবাণুকে (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া) রোগ সৃষ্টিতে বাধা দেয়। এমনকি ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে এই উপাদানের ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত।  

SARS-CoV-2 ভাইরাস কীভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে?

কোনও কক্ষে ঢুকতে গেলে আমাদের যেমন দরজা লাগে, ভাইরাসেরও কোষের ভেতরে ঢুকতে গেলে এরকম দরজার প্রয়োজন হয়। সাধারণত প্রাণী কোষের কোষপর্দায় থাকা কোনও প্রোটিন অণু বা কোনও রিসেপ্টর, এক্ষেত্রে দরজার মতো কাজ করে। তবে, এক্ষেত্রে একই দরজা তথা রিসেপ্টর  দিয়ে, একই সময়ে একাধিক অণু প্রবেশ  করতে পারে না।

করোনাভাইরাস (SARS-CoV-2)-এর গঠন গোলাকার এবং এই গোলাকার গঠনের বাইরে কাঁটা বা স্পাইক থাকে, এই স্পাইকের মাধ্যমে ভাইরাস কোনও মানব কোষের সঙ্গে যুক্ত হয়। ভাইরাসটি প্রাথমিকভাবে মানুষের কোষ আবরণীতে থাকা Heparin Sulphate Proteoglycan (HSPG) নামক প্রোটিন অণুর সঙ্গে আবদ্ধ হয়। তারপর, Angiotensin Converting Enzyme 2 (ACE 2) নামক একটি রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভাইরাস কোষের ভেতরে প্রবেশ করে এবং পরবর্তীতে কোষের ভেতরেই তার সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটিয়ে রোগ সৃষ্টি করে।

ল্যাকটোফেরিন কীভাবে COVID-19-এর বিরুদ্ধে কাজ করে?  

গবেষণায় দেখা গেছে, SARS-CoV-2 ভাইরাস যে দরজা বা রিসেপ্টরের মাধ্যমে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে, ল্যাকটোফেরিনও একই রিসেপ্টর (ACE 2 বা দরজা ব্যবহার করে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে।

সংক্রমণ আটকে দেওয়ার প্রক্রিয়া

ল্যাকটোফেরিনের সরবরাহ থাকলে, ল্যাকটোফেরিন অণু প্রথমে কোষ পর্দায় অবস্থিত HSPG অণুর সঙ্গে এবং পরে ACE 2 রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয় (চিত্রে উল্লেখিত)। এতে, SARS-CoV- 2  ভাইরাসের কোষে প্রবেশের দরজা বা রিসেপ্টর বন্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায়, SARS-CoV-2 ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলেও রিসেপ্টর বা দরজা খোলা না থাকায়, ভাইরাস  আর কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না । ফলে ভাইরাসের মাধ্যমে কোনও রোগ সৃষ্টি হয় না।  

তাই, শরীরে পর্যাপ্ত ল্যাকটোফেরিন থাকলে, সেটি SARS-CoV-2 ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করলেও তেমন ক্ষতি করতে পারে না।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর দেহে Interleukin(IL)-6, Tumor Necrosis Factor Alpha (TNFα)-এর মতো প্রদাহ উদ্রেককারী পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়; যার ফলশ্রুতিতে তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ল্যাকটোফেরিন এসব পদার্থের ক্ষরণ কমিয়ে শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তি দেয়।  পাশাপাশি, IL-4,  IL-10-এর মতো উপকারী পদার্থ বাড়িয়ে এবং Nuclear Factor-Kappa কমিয়ে দিয়ে, শরীরের প্রদাহজনিত সমস্যা প্রশমনে ল্যাকটোফেরিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  

কোথায় পাবো ল্যাকটোফেরিন?

উন্নত বিশ্বে ল্যাকটোফেরিন সমৃদ্ধ বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট (ক্যাপসুল/সলিউশন) পাওয়া গেলেও আমাদের দেশে সেটি অপ্রতুল। তাই আমাদের দেশে ল্যাকটোফেরিনের চাহিদা পূরণের একমাত্র বিকল্প উৎস গরুর দুধ (শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের দুধ)। গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের শালদুধ সবচেয়ে বেশি ল্যাকটোফেরিন সমৃদ্ধ (প্রতি লিটারে ৭-৮ গ্রাম)। এছাড়া, মায়ের দুধ থেকে লিটারপ্রতি ১-২ গ্রাম এবং প্রতি লিটার গরুর দুধ থেকে ০.০২-০.২ গ্রাম ল্যাকটোফেরিন আমরা পেতে পারি।

দেশীয় বাজারে, স্বল্প পরিমাণ আমদানিকৃত ল্যাকটোফেরিন সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়; তবে, এসব সাপ্লিমেন্ট সেবনের আগে এর  মান যাচাই  করার ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া উচিত।

সেবনের  উপায়-

আমাদের দেশীয় বাজারে দুধ বিভিন্ন আকারে পাওয়া যায়, যেমন- স্থানীয় খামার থেকে সংগ্রহ করা মোড়কজাত (প্যাকেটজাত) ও অমোড়কজাত কাঁচা তরল দুধ, পাস্তুরিত তরল দুধ, Ultra Heat Treated (UHT) Milk এবং গুঁড়োদুধ। এদের মধ্যে UHT Milk এবং গুঁড়োদুধকে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় প্রক্রিয়াজাত করা হয়। উচ্চ তাপমাত্রায় ল্যাকটোফেরিনের গঠন নষ্ট হয়ে যায় বলে, UHT Milk এবং গুঁড়োদুধে  ল্যাকটোফেরিনের কার্যক্ষমতা থাকে না বললেই চলে। তবে, UHT Milk এবং গুঁড়োদুধে ল্যাকটোফেরিন ছাড়া অন্যান্য পুষ্টিগুণ বেশিরভাগ বজায় থাকে।

খামার থেকে সংগৃহীত তরল দুধ ও পাস্তুরিত তরল দুধকে সর্বোচ্চ ৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয় বলে এসব দুধে ল্যাকটোফেরিনের গুণাগুণ বজায় থাকে। এ কারণে ল্যাকটোফেরিন পাওয়ার উদ্দেশ্যে দুধ পান করলে কাঁচা অথবা পাস্তুরিত তরল দুধকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তবে, পান করার আগে এসব তরল দুধ অতিরিক্ত তাপমাত্রায় গরম করা যাবে না। কারণ, এক্ষেত্রেও ল্যাকটোফেরিনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে।  সর্বোচ্চ ৫৫-৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (মৃদু গরম) গরম করে এই দুধ পান করতে হবে।

এছাড়া বাজারে কিছু আমদানিকৃত দুগ্ধজাত পণ্য আছে, যাতে আলাদাভাবে ল্যাকটোফেরিন যুক্ত করা হয়। মান বিবেচনায়, মোড়কে উল্লেখিত উপায়ে এসব পণ্য সেবন করা যেতে পারে।

দুধ পানের উপকারিতা ও কোভিড-১৯ নিরাময়ে দুধের ভূমিকা-

পুষ্টিমান বিবেচনায়, দুধ প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সর্বোত্তম খাবার। দুধে বিদ্যমান প্রোটিন, শর্করা, খনিজ (জিংক, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি) এবং ভিটামিন সকল বয়সী মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটায়। মায়ের দুধপানের মাধ্যমে, মায়ের শরীর থেকে শিশুতে অ্যান্টিবডি স্থানান্তরিত হয়; যা শিশুকে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। মায়ের দুধ শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ ও শারীরিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পূর্ণবয়স্ক মানুষে, দুধ প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি শরীর গঠন ও অন্ত্রের হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দুধের অন্যতম উপাদান ল্যাকটোফেরিন, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ভালো কাজ করে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, শরীরের প্রদাহজনিত সমস্যা কমায় এবং দেহে ক্যানসার কোষ সৃষ্টিতে বাধা দেয়।

প্রাথমিক গবেষণায় সফলতা এলেও কোভিড ১৯ প্রতিরোধে ল্যাকটোফেরিনের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য আরও বৃহৎ পরিসরে গবেষণার প্রয়োজন। তবে, SARS-CoV-2-এর সমগোত্রীয় Middle East Respiratory Syndrome-related coronavirus (MERS-CoV) এবং Severe Acute Respiratory Syndrome- related coronavirus (SARS-CoV)-এর মতো ভাইরাসের বিরুদ্ধে ল্যাকটোফেরিন কার্যকর হওয়ায় বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি  SARS-CoV-2-এর বিরুদ্ধেও কাজ করবে।

তাই, ল্যাকটোফেরিন ও দুধের অন্যান্য পুষ্টিগুণ বিবেচনায় সব বয়সী মানুষের নিয়মিত দুধ পান করে, নিজের শারীরিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা উচিত। নিজস্ব শারীরিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে, আমরা জাতিগত এবং বৈশ্বিকভাবে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারি। পরিশেষে বলা যায়, দুধপানে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ সম্ভব- এটি মোটেও মনগড়া কথা নয়; বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও গবেষণালব্ধ তথ্য প্রমাণ করে, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে দুধের ভূমিকা রয়েছে।  

লেখক: অধ্যাপক (দুগ্ধবিজ্ঞান), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

E-mail: [email protected][email protected]

সহযোগী লেখক: সুজয় বড়ুয়া, এম.এস. শিক্ষার্থী (দুগ্ধবিজ্ঞান), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ