X
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫
৫ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় এগিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস!

হিটলার এ. হালিম
০২ আগস্ট ২০২০, ০৮:৫৯আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২০, ০৮:৩০

কোভিড-১৯

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত দিক থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছেন সবাই। প্রযুক্তির মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগের ঝুঁকি নির্ণয়, নিয়ন্ত্রণ ও লোকেশন চিহ্নিত করা যাচ্ছে। এছাড়া তৈরি হয়েছে চ্যাটবট, অ্যাপস, ওয়েবসাইট ইত্যাদি। মহামারি থেকে সুরক্ষা পেতে দেশীয় দুটি প্রতিষ্ঠান ভেন্টিলেটরসহ অন্যান্য মেডিক্যাল সরঞ্জাম তৈরি করছে।

বিভিন্ন হ্যাকাথনের (যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কোনও সমস্যার সমাধান বা উদ্ভাবন বের করা হয়) মাধ্যমে করোনা মোকাবিলার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। জীবাণু বিষয়ক তথ্যের জন্য ন্যাশনাল ডেটা অ্যানালিটিকস টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে। ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথের ব্যবহার বেড়েছে, একইসঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে নির্দিষ্ট প্রযুক্তি পণ্যের বিক্রি।

দেশে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবি’র সভাপতি আমিনুল হাকিম উল্লেখ করেন, করোনার সময় দেশে ব্যান্ডউইথের ব্যবহার বেড়েছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ১ হাজার ৭৫০ জিবিপিএসের চেয়ে বেশি। তাদের দুটি সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ থাকার ফলে ব্যান্ডউইথের কোনও ঘাটতি পড়েনি। এখনও প্রচুর ব্যান্ডউইথ অব্যহৃত অবস্থায় রয়েছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গ্রাহক গত তিন মাসে ২৩ লাখেরও বেশি বেড়েছে। এখন মোট গ্রাহকের সংখ্যা এক কোটির বেশি বলে মনে করেন তারা। তার দৃষ্টিতে, ‘সবই ডিজিটাল বাংলাদেশের ফলে সম্ভব হয়েছে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাস বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার দিকে থেকে অন্তত কয়েক বছর এগিয়ে দিয়েছে! ই-কমার্স খাতের প্রবৃদ্ধি অভাবনীয় বলে উল্লেখ করেছেন তারা। তাদের মন্তব্য, গত ১০-১১ বছরে ই-কমার্স খাত যতটা এগিয়েছে তার চেয়ে দেড়গুণের বেশি এগিয়েছে সবশেষ পাঁচ মাসে।

অনলাইনে ডিজিটাল পণ্য ক্রয়-বিক্রয় বেড়েছে। মোবাইল ফোন বিক্রি হয়েছে প্রচুর। এখনও অনেক ক্রেতা সাবধানতা অবলম্বন করে মার্কেটে না গিয়ে অনলাইন মাধ্যম থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনছেন। চালু হয়েছে একাধিক অনলাইন শপ। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ফিজিক্যাল স্টোর চালু করেছে। এগুলো তাদের পিকআপ পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে গ্রাহকদের কাছে। মূলত ঢাকা শহরে ক্রেতাদের কাছে দ্রুত পণ্য পৌঁছে দিতে এমন শপ ও সেবা চালু করেছে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ব্যবসায়ীরা।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক মনে করেন, লকডাউনের সময় এবং এলাকাভিত্তিক লকডাউনে ই-কমার্স খাত বড় ভূমিকা রেখেছে। তার কথায়, ‘গত ১০-১১ বছর ধরে ই-কমার্সকে আমরা যতটা জনপ্রিয় করতে চেয়েছি, গত পাঁচ মাসে তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় করতে পেরেছি। প্রায় সব পর্যায়ের লোকজন এখন বুঝতে পেরেছেন ই-কমার্স কী।’

প্রতিমন্ত্রীর দাবি, গত পাঁচ মাসে ই-কমার্সে ৫০ শতাংশ কেনাকাটা বেড়েছে। তিনি জানান, ই-কমার্সকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে ফুড ফর নেশন, একশপের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। করোনাকালে এসব মাধ্যমে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছানো গেছে। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সরকারিভাবে অনলাইনে ডিজিটাল হাটের আয়োজন করা হয়। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী কোরবানি সম্পন্ন হওয়ার পর মাংস প্রক্রিয়াজাত করে হোম সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। সবই ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রতিমন্ত্রী উল্লেখ করেন, এমন প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলে ২০২৫ সালে ই-কমার্স বাজারের আকার হবে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২৫ সালের মধ্যে এই খাতে আরও ৫ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে আশাবাদী তিনি।

জুনাইদ আহমেদ পলক মনে করেন, করোনা পরিস্থিতিতে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছেন দেশের মানুষ। তিনি বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নাগরিকদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। কলসেন্টারে ফোন করে, ওয়েবসাইটে ঢুকে ও অ্যাপসের মাধ্যমের করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানা যাচ্ছে ও জানানো যাচ্ছে। করোনার উপসর্গ থাকলে ফোন করে পরীক্ষার জন্য তথ্য জানানো যাচ্ছে। ঝক্কি এড়াতে অনলাইনে পরীক্ষার সিরিয়াল নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ওটিটি (ওভার দ্য টপ) সেবা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মেসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপে তথ্যর জন্য যোগাযোগ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা (হ্যাকাথন) আয়োজন করে করোনাকালে মানুষকে কীভাবে আরও সেবা দেওয়া যায় সেই উপায় বের করা হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা কোন এলাকায় আছেন, কোন কোন এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ সেসব হ্যাকাথনের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেউ সেই এলাকা দিয়ে গেলে বা সেখানে থাকলে করোনা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা জানিয়ে মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে।’

জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা মেনে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও চ্যাটবট তৈরি করেছে সরকারের আইসিটি বিভাগ। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে তিন কোটির বেশি। মেসেঞ্জারে বড় সংখ্যক ব্যবহারকারীর জন্য তৈরি হয়েছে মেসেঞ্জার বট। এছাড়া দেশের সাড়ে তিন কোটি হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারী ও দেড় কোটি ভাইবার ব্যবহারকারীর জন্য তৈরি হয়েছে চ্যাটবট। এগুলো ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবহারকারীদের সুবিধার্থে এসব বাংলা ভাষায় রাখা হয়েছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের রয়েছে ‘করোনা আইডেন্টিফায়ার’ নামের একটি অ্যাপ। করোনাভাইরাস নিয়ে ভীতি দূরীকরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও আশপাশের মানুষ কেউ এতে আক্রান্ত কিনা সেই বিষয়ে তাৎক্ষণিক তথ্য দিচ্ছে এটি (http://coronaidentifier.teletalk.com.bd/)।

‘কোভিড ফাইন্ডার’ নামের একটি বিশেষ অ্যাপ তৈরি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামান এবং একই ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী রাজন হোসেন। তাদের দাবি, এর ব্যবহারকারীরা দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন কিনা তা এই অ্যাপ জানাতে সক্ষম।

ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে একাধিক হাইটেক পার্ক। এরমধ্যে বেরসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা মিনিস্টার হাইটেক পার্ক ইলেক্ট্রনিকস লিমিটেড তৈরি করছে ভেন্টিলেটর।

ওয়ালটনের হাইটেক পার্কে তৈরি হচ্ছে করোনাকালের জন্য বিভিন্ন সহায়ক অনুষঙ্গ। এর জনসংযোগ বিভাগ জানায়, দুর্যোগের শুরু থেকেই বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রী ও মেডিক্যাল সরঞ্জাম তৈরির উদ্যোগ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণ ছুটির সময় তাদের শতাধিক প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা নিরলস প্রচেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যে ভেন্টিলেটরের তিনটি মডেল (ফাংশনাল) তৈরি করে। এর একটি বিশ্বখ্যাত মেডিক্যাল সরঞ্জাম মেডট্রনিক্স’র ডিজাইন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তায় তৈরি। এছাড়া ফেস শিল্ড, সেফটি গগলস, ইউভিসি ডিসইনফেক্ট্যান্ট সিস্টেম, মেডিকার্ট রোবট, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি তৈরি করছে ওয়ালটন। বর্তমানে ওয়ালটন কারখানায় দৈনিক ৮ হাজার ফেস শিল্ড ও ৮ হাজার সেফটি গগলস তৈরির সক্ষমতা আছে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রেনিউর ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা আরিফ নিজামি আশাব্যঞ্জক কণ্ঠে শোনালেন, ‘করোনাভাইরাস আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার দিক দিয়ে অন্তত কয়েক এগিয়ে দিয়েছে। যে প্রযুক্তি আরও কয়েক বছর পরে আসার কথা ছিল তা এখনই চলে এসেছে।’

একটি হ্যাকাথনের সঙ্গে যুক্ত আরিফ নিজামি বলেন, ‘হ্যাকাথনের মাধ্যমে আমরা সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন প্রযুক্তির খোঁজ পেয়েছি। অনলাইন আলোচনার কিছু সফটওয়্যার এরইমধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করিয়ে ফেলেছে, স্বাভাবিক সময়ে যা অনেক বেশি সময় নিতো।’

গত ১০ মে দেশের দুই বড় কম্পিউটার মার্কেট চালুর পর (সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে) প্রযুক্তি পণ্যের বিক্রি বেড়েছে। জানা গেছে, এ সময় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি প্রযুক্তি পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে। অনলাইন বৈঠকের ডিভাইস ও ল্যাপটপের বিক্রি বেড়েছে।

প্রযুক্তিপণ্য ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) যুগ্ম সম্পাদক মুজাহিদ আল বেরুনী সুজন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মার্চ থেকে সব মার্কেট, দোকানপাট বন্ধ ছিল। ফলে একটা বড় ধরনের চাহিদা তৈরি হয়েছিল প্রযুক্তি পণ্যের। মার্কেট খোলার পর এর কিছুটা মিটেছে। বেশি বিক্রি হচ্ছে অনলাইন বৈঠক করার ডিভাইস।

বিসিএস যুগ্ম সম্পাদক জানান, একটি প্রতিষ্ঠান এক মাসে একই ব্র্যান্ডের রাউটার বিক্রি করেছে ৬০ হাজার পিস। তার মন্তব্য, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এমন। তবে তিনি হতাশার সুরে বলেন, ‘সার্বিকভাবে প্রযুক্তি পণ্যের বাজার ভালো নয়। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক।’

 

/জেএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মেঘনা সেতুতে উল্টে গেছে ট্রাক, ৮ কিলোমিটার যানজট
মেঘনা সেতুতে উল্টে গেছে ট্রাক, ৮ কিলোমিটার যানজট
ট্রাক-পিকআপ সংঘর্ষে ৪ জন নিহত
ট্রাক-পিকআপ সংঘর্ষে ৪ জন নিহত
সুন্দরবনে আবারও দস্যু আতঙ্কে জেলে-বনজীবীরা
সুন্দরবনে আবারও দস্যু আতঙ্কে জেলে-বনজীবীরা
দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনে ৯ গোলের থ্রিলার জিতে সেমিফাইনালে ম্যানইউ
দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনে ৯ গোলের থ্রিলার জিতে সেমিফাইনালে ম্যানইউ
সর্বাধিক পঠিত
ঋণের কিস্তি ছাড় স্থগিত রাখলো আইএমএফ
ঋণের কিস্তি ছাড় স্থগিত রাখলো আইএমএফ
২৯ ঘণ্টা বন্ধ থাকবে খিলক্ষেত-কুড়িল-বসুন্ধরা সড়ক
২৯ ঘণ্টা বন্ধ থাকবে খিলক্ষেত-কুড়িল-বসুন্ধরা সড়ক
ভাসানচরকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে অন্তর্ভুক্ত না করতে আইনি নোটিশ
ভাসানচরকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে অন্তর্ভুক্ত না করতে আইনি নোটিশ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ, উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ, উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ
গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের মালিকানা কমলো
গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের মালিকানা কমলো