X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজের গলদ দূর করতে শর্ট ফিল্ম

স্বদেশ রায়
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:০২আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:১৬

স্বদেশ রায় জিয়া ও এরশাদের আমলে মুক্তিযুদ্ধকে যতভাবে নির্বাসনে পাঠানো যায় তার সব চেষ্টা করা হয়েছিল। এ দুটো আমলই বাংলাদেশের অন্ধকার যুগ, কালো অধ্যায়। বাংলাদেশে এই অন্ধকার যুগ দুটি শুধু যে অর্থনীতিকে পিছিয়ে দিয়েছে তা নয়, বাংলাদেশে মৌলবাদ সৃষ্টি করেছে ও তার ভিত্তি মজবুত করেছে। এই অন্ধকার সময়ে বাংলাদেশের নানান আন্দোলনের সঙ্গে শর্ট ফিল্ম আন্দোলনের বিশাল ভূমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং মৌলবাদের ও রাজাকারদের উত্থানের বিরুদ্ধে। সে সময়ে ‘আগামী’ ‘হুলিয়া’র মতো শর্ট ফিল্ম হয়েছিল। আরো অনেক শর্ট ফিল্ম হয়েছিল। যা ছিল সত্যি সময়ের প্রয়োজনে কালজয়ী শিল্পকর্ম। আর তার ভূমিকা কী ছিল ওই সময়ে, একেকটি তরুণ ও কিশোরকে কতটা বদলে দিতো ওইসব শর্ট ফিল্ম, সেটা আজ প্রৌঢ় অথচ সে সময়ের তরুণদের বুকে খোঁচা দিলেই বের হয়ে আসে।

আজ সময় বদলে গেছে, আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা হচ্ছে স্বাধীনভাবে। জাতি বঙ্গবন্ধুর জম্ম শতবার্ষিকী পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিপুল সংখ্যক তরুণের মনোজগতে এখন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শ। নানানভাবে নানান দৃষ্টিকোণ দিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে জানার ও বোঝার চেষ্টা করছে। তারা বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনার মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক জীবনে পৌঁছাতে চায়, একটি সমাজ বিনির্মাণ করতে চায়। করতে চায় একটি চিন্তার মুক্তির সমাজ। কিন্তু বাস্তবে সত্য হলো এই তরুণরা বাংলাদেশের সব তরুণ নয়। এই তরুণদের বাইরেও বিশাল সংখ্যক তরুণ আছে, যারা আমাদের আগামী দিনের নাগরিক, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই তরুণরা কেউ ‘আগামী’ শর্ট ফিল্মটির ওই বালকের মতো ইট ছুড়ে মারছে না রাজাকারের গায়ে বা রাজাকারি চিন্তার ওপর। রাজাকার মানে কখনই কিন্তু শুধু যে কিছু লোক বাঙালি হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, সেই লোকগুলো নয়। রাজাকার মানে পশ্চাদপদতা, রাজাকার মানে পাকিস্তানি চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক। আর পাকিস্তানের মূল চিন্তা-চেতনা ১৯৫৮ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বদলে গেছে। ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য যে রাষ্ট্রটি তৈরি হয়েছিল, তা ১৯৫৮ সাল থেকে সামরিক শাসকরা ধীরে ধীরে বদলে ফেলে। বাঙালিরা সচেতন ছিল, সর্বোপরি তাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা ছিল, তাই তারা ১৯৭১ সালে রক্ত দিয়ে, আব্রু দিয়ে পাকিস্তান নামক দেশ থেকে থেকে বের হয়ে আসতে পারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কিন্তু ১৯৪৭ সালের সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের আর অস্তিত্ব থাকে না, থাকে সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ‘বাকিস্তান’। আর যাই হোক বাকিস্তান কোনও রাষ্ট্র হতে পারে না। বাকিস্তান তাই হয়ে দাঁড়ায় একটি পরিত্যক্ত ভূমি। অর্থাৎ আগাছা জন্মানোর প্রকৃষ্ট স্থান। বাস্তবে হয়েছেও তাই। নাম আছে বটে পাকিস্তান একটি স্বাধীন ভূমি; কিন্তু সেটা আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সর্বোত্তম বিচরণ ক্ষেত্র। এই বাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র চীন থেকে শুরু করে ইউরোপের কোনও দেশে আবার প্রতিবেশী ভারতে যেখানেই জঙ্গি হামলা হয় সবখানে অন্তত একজন জঙ্গি মিলবে যে পাকিস্তানে ট্রেনিং নিয়েছে। পাশাপাশি অস্ত্র থেকে শুরু করে মাদকসহ সব ধরনের চোরাচালানের অভয়ারণ্য পাকিস্তান। এর ওপর রয়েছে সবধরনের পশ্চাদপদতা তাদের সমাজজুড়ে, সঙ্গে সামাজিক নিষ্ঠুরতা। আর এই পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বই করে বাংলাদেশে রাজকার বা রাজাকারি ভাবনাচিন্তা।

বাংলাদেশের সমাজে এখনও রয়েছে এক শ্রেণির তরুণের মনে জঙ্গি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। তারা সংখ্যায় কম হলেও একেবারে নগণ্য নয়। রয়েছে পশ্চাদপদ একটি শিক্ষার ধারা। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মাদক। এছাড়া এখন সময় এসেছে সমাজের অনেক কুসংস্কার, অনেক পশ্চাদপদতা দূর করা।

আবার সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তারও কিছু খারাপ প্রভাব সমাজে পড়তে শুরু করেছে। যেমন এসেছে নানান ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কডিন, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ নানান মাধ্যম। এসব যোগাযোগমাধ্যমের ভেতর দিয়ে সারা দুনিয়া এক হয়েছে। নতুন প্রজম্ম তাদের নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারছে নানান ধরনের ইনফরমেশনে। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে ভালো-মন্দ বিচার করতে না পারার অক্ষমতা।

সমাজেও পশ্চাদপদতা বর্তমান থাকা এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবর্তিত সমাজের কিছু কিশোর ও তরুণ যে প্রযুক্তিকে খারাপ কাজে ব্যবহার করছে, এ দুটিই সমাজের অনেক বড় সমস্যা। এই সমস্যাকে এখন রাষ্ট্র ও সমাজকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, কোনও সমাজে যদি পশ্চাদপদ তরুণ শ্রেণি থাকে আবার আধুনিক কোনও প্রযুক্তিকে খারাপ কাজে লাগানোতে ব্যস্ত থাকে কোনও তরুণ শ্রেণি সেটা ওই সমাজের জন্য অনেক বড় ভয়াবহ বিষয়। এখান থেকে সমাজকে মুক্ত করতে না পারলে কোনও মতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন। আর এ অবস্থাতে সব থেকে বেশি প্রয়োজন এই পশ্চাদপদ তরুণ শ্রেণি ও প্রযুক্তিকে যারা খারাপ কাজে ব্যবহার করছে এই তরুণ শ্রেণিকে মোটিভেট করা, যাতে তারা আর এ ধরনের খারাপ কাজ না করে। আর এই মোটিভেট করার কাজে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে শর্ট ফিল্ম। সরকারি উদ্যোগে ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে এই শর্ট ফিল্মগুলো।

যেমন ধরা যাক গ্রামীণফোন তাদের বিজ্ঞাপন দেয় কোটি কোটি হাত এক হয়ে যাচ্ছে এই ফোনের মাধ্যমে। এ ধরনের বিজ্ঞাপন না দিয়ে তারা যদি একটি ১০ মিনিটের শর্ট ফিল্ম তৈরি করায় কোনও তরুণ উদ্ভাবক পরিচালককে দিয়ে, যার বিষয়বস্তু হবে একটি মেয়ের ছবি ভিন্নভাবে ধারণ করে তা ফেসবুকে ভাইরাল করলে শেষ পর্যন্ত একটি মেয়ের জীবনে কী নেমে আসে ও তার পরিবারকে কত বড় দুঃখ বহন করতে হয়। আর সেটা যদি সত্যি সত্যি হৃদয়গ্রাহী হয়, মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয়, তাহলে সমাজে এর প্রভাব অনেক বেশি। আর তখন কিন্তু মানুষের মুখে মুখে ছড়াবে গ্রামীণফোনের ওই শর্ট ফিল্মটির কথা। এর ফলে একদিকে সমাজ যেমন পরিবর্তন হবে অন্যদিকে বিজ্ঞাপনদাতা তার পণ্যের প্রচারও বাড়াতে পারবেন অনেক বেশি। এটা শুধু করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি নয়, এটা সবার একটি নৈতিক দায়িত্বও। ঠিক একইভাবে পশ্চাদপদ শিক্ষা নিয়ে একটি ছেলের জীবন কোথায় পড়ে থাকে অন্যদিকে অন্য একটি দরিদ্র ছেলে আধুনিক শিক্ষা নিয়ে একপর্যায়ে কোথায় চলে যায়, এ নিয়েও হতে পারে আরেকটি শর্ট ফিল্ম। যে গল্পের ভেতর দিয়ে ওইসব তরুণের মনে আশা জাগবে তারা আধুনিক শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের বাবা-মাকে বোঝাবে। ঠিক এই একই কাজ করতে হবে সরকারিভাবে। এভাবে তরুণ উদ্ভাবক শর্ট ফিল্ম কর্মীরা তাদের আধুনিক চিন্তা দিয়ে বদলে দিতে অনেক বেশি সাহায্য করতে পারে রাষ্ট্র ও সমাজকে।

বাস্তবে বর্তমান মুহূর্তে অনেকেরই ইচ্ছা থাকলে তাদের দীর্ঘ নাটক বা দীর্ঘ ফিল্ম দেখার সুযোগ নেই। তবে তার আবেদন বিন্দুমাত্র ফুরায়নি। এই দুই শক্তিশালী মাধ্যম কাজ করে যাবে ঠিকই, তারপরও বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় শর্ট ফিল্মকে অনেক বেশি কাজে লাগানো যায়। কারণ, মানুষ মাত্রই একটি জীবনের বা সমাজের গল্প শুনতে ভালোবাসে, তাই সে গল্প যত ছোট আকারে হোক না কেন? আর গল্প ছোট হোক, মেসেজ যদি তীক্ষ্ণ থাকে তাহলে দৈর্ঘ্য কতটুকু তা কেউ মাপতে যায় না। তাই বর্তমানের এই সমাজ বাস্তবতায় সত্যি অর্থে সময় এসেছে শর্ট ফিল্ম মাধ্যমটিকে কাজে লাগানো। আশা করা যায়, সরকার, তরুণ ফিল্ম কর্মীরা ও বাণিজ্যিক হাউসগুলোর সহায়তা এই তিন মিলে সমাজ ও মনোজগৎ পরিবর্তনে এ মাধ্যমকে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমরা দেখতে পাবো আগামীর আরেকটি বালক ইট ছুড়ছে পশ্চাদপদতার ওপর বা যেকোনও ধরনের নষ্টামির প্রতি।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ