দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। আগামী ১০ অক্টোবর বুধবার এই মামলার রায় ঘোষণা করবেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। মঙ্গলবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রায় ঘোষণার এই তারিখ জানানো হয়। মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে রায়ের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করায় বিচারকও সবার প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে মামলাটির তদন্ত প্রক্রিয়া ও বিচার কাজ সহজ ছিল না। তদন্ত ও বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টার অভিযোগও উঠেছে অনেক সময়। বিভিন্ন সময় তদন্ত আলাদা দিকে মোড় নিয়েছে। মামলাটির প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতেই সময় লাগে চার বছরের বেশি। আরও তিন বছর পর জমা দেওয়া হয় একটি সম্পূরক চার্জশিট। এরপর আরও সাত বছর ধরে বিচার কাজ করার পর অবশেষে রায় ঘোষণা করা হচ্ছে।
২০০৪ সালে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ২৩ নম্বর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে ঘটনাস্থলে ও পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন কয়েকশ লোক। এ ঘটনায় পরদিন ২২ আগস্ট দণ্ডবিধির ১২০/বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ২০১, ১১৮, ১১৯, ২১২, ৩৩০, ২১৮, ১০৯ ও ৩৪ ধারায় মতিঝিল থানার এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা (নং-৯৭) দায়ের করেন।
বর্বরোচিত ও ভয়াবহ ওই গ্রেনেড হামলার ঘটনার তদন্ত নিয়েও ঘটেছে নানা নাটকীয় ঘটনা। সাজানো হয়েছিল জজ মিয়া নাটক। মামলা দায়েরের পর প্রথমে মতিঝিল থানা পুলিশ ও পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ তদন্ত করে। গোয়েন্দা পুলিশ কিছুদিন মামলাটির তদন্ত চালানোর পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দায়িত্ব দেওয়া হয়। সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ পর্যায়ক্রমে তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়ে মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তদন্ত শুরুর কয়েকদিন পরই নোয়াখালীর সেনবাগের জজ মিয়া নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে গ্রেনেড হামলার রহস্য উদঘাটনের দাবি করেন সিআইডি’র কর্মকর্তারা।
২০০৭ সালে ১/১১-এর পট পরিবর্তনের পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির এএসপি ফজলুল কবিরকে। ২০০৮ সালের ৯ জুন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে সিএমএম আদালতে দু’টি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন এএসপি ফজলুল কবির। ওই বছরই মামলা দু’টির কার্যক্রম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ স্থানান্তর করা হয়। নাজিম উদ্দিন রোডে পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে পিডব্লিউডির একটি পুরনো সরকারি ভবনকে অস্থায়ী আদালত ঘোষণা করা হয়। এ আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে ২৯/১১ (হত্যা) ও ৩০/১১ (বিস্ফোরক) মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম চলে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় গেলে পুরোপুরি পাল্টে যায় এ মামলার তদন্তের ধারা। ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের পর ২০০৯ সালের ২৫ জুন আদালতের কাছে এ মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন জানায় রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ওই বছরের ৩ আগস্ট আদালত অধিকতর তদন্তের আবেদন মঞ্জুর করেন। অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দকে। দীর্ঘ তদন্তের পর তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ আরও ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে ২০১১ সালের ২ জুলাই আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। অধিকতর তদন্তে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) পাশাপাশি হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতাও খুঁজে পান তিনি। মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অভিযোগে সিআইডি’র প্রথম তিন তদন্ত কর্মকর্তাকেও অধিকতর তদন্তে অভিযুক্ত করেন আবদুল কাহার আকন্দ।
চার্জ গঠনের পর বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। মামলায় ২২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এরপর সাক্ষীদের জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। পরে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ ১১৯ কার্যদিবস যুক্তিতর্কের মাধ্যমে শুনানি করে। এতে আসামিপক্ষ ৯০ কার্যদিবস এবং রাষ্ট্রপক্ষ ২৯ কার্যদিবস শুনানি করেছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান। মঙ্গলবার ১১৯ তম কার্যদিবসে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। এরপরই আদালত আগামী ১০ অক্টোবর রায়ের দিন ধার্য করেন।
অধিকতর তদন্তের পর সম্পূরক চার্জশিটে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৩০ জন আসামি যুক্ত হওয়ার পর এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম বিপুলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তাদের এই মামলায় আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। মামলার বর্তমান আসামি সংখ্যা ৪৯। এসব আসামির মধ্যে পলাতক রয়েছেন ১৮ জন। কারাগারে আছেন ২৩ জন। জামিনে ছিলেন আটজন।
মঙ্গলবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রায়ের দিন ধার্য করার পর জামিনে থাকা আটজনের জামিন বাতিল করে তাদেরও কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল -১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন বলেন, ‘আসামিরা জামিনে থাকলে বিচারে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য আসামিদের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হলো।’
রায়ের দিন ঘোষণা করার আগে বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন মামলা চলাকালে সহযোগিতা করার জন্য রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের উপস্থিত আইনজীবী, আসামি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সংবাদমাধ্যমকর্মীদের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন। মামলার আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী প্রয়াত টিএম আকবর হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন বলেন, ‘শুধু আসামিপক্ষেই নয়, তিনি নিরপেক্ষভাবে এ মামলায় আদালতকে সহযোগিতা করেছেন।’
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান প্রসিকিউটর (পিপি) সৈয়দ রেজাউর রহমানও বিচারকাজে সহযোগিতার জন্য আদালতসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগই তারা প্রমাণ করতে পেরেছেন। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী এসএম শাহজাহান বলেন, ‘এ মামলায় আসামিদের সাজা দেওয়া যায় এমন কোনও তথ্য-প্রমাণ আমরা পাইনি। আমরা ন্যায়বিচারের প্রতীক্ষায় থাকলাম। আশা করি,সেই ন্যায়বিচার থেকে আমরা বঞ্চিত হব না।’
অার পড়ুন: ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ১০ অক্টোবর
শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয় যেভাবে
